শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১২

পরিস্থিতি বাউলকে বদলে দিচ্ছে - পবন দাস বাউল

দেশ টিভির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালায় গান করতে তিন দিনের জন্য ঢাকায় আসেন পবন দাস বাউল। গতকাল বিকেলে চলে যান কলকাতায়। ঢাকায় তিনি থেকেছেন ঢাকা ক্লাবের অতিথিশালায়। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে এখানেই কথা হলো প্যারিস-প্রবাসী এই কণ্ঠশিল্পীর সঙ্গে।

ঢাকায় এসে কেমন লাগছে?
গরমটা বেশি। আগেও এসেছি। কখনোই বেড়ানো হয় না। গান গেয়েই ফিরে যাই। দেশ টিভিতে বুধবার রাতে গান করেছি। অনেকেই ফোন করেছেন। ভালোই লেগেছে।
বাংলাদেশের শিল্পীদের গান শোনা হয়?
আব্দুল আলীম, আব্বাসউদ্দীন আহমদ, নির্মলেন্দু চৌধুরী, মুজিব পরদেশীর গান শুনেছি। আগেরবার যখন এসেছিলাম, তখন অনেকেই আমাদেরকে বিভিন্ন শিল্পীর ক্যাসেট উপহার দিয়েছিলেন। সেগুলো প্যারিসে নিয়ে যাই। মাঝে মাঝেই শোনা হয়।
একটু পেছন ফিরে যেতে চাই। বাউলগানের সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?
আমার জন্ম মুর্শিদাবাদে, গ্রামের নাম মোহাম্মাদপুর। বাবা দিবাকর দাস কীর্তন ও কবিগান করতেন। আমাদের অল্প কিছু জমি ছিল। তাতে বাবা চাষ করতেন। বাবা লাঠিখেলায় খুব দক্ষ ছিলেন। কুস্তিও লড়তেন। হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। জমি বিক্রি করে চিকিৎসা করালেন। লাভ হলো না। আর কাজ করতে পারেননি। তখন আমার বয়স ছয় বছর। ঘরে বাবা-মা ভাইবোনসহ সাতজন। এরপর বাবা ভিক্ষা শুরু করলেন। মাধুকরি গান গাইতেন। বাবা প্রথম লাইন বলতেন, আমি তাঁর সঙ্গে দোহারি করতাম আর নাচতাম। বাবার সঙ্গে মাধুকরি করতে গিয়ে আমি অনেক জায়গায় ঘুরেছি—বাজারে, রাস্তায়, ট্রেনে—কত জায়গায় যে গান করেছি, হিসাব নেই। ওই সময় বাউলগান দারুণ পছন্দ হয়। বাউলগানের কথা আর সুর আমাকে দারুণ নাড়া দেয়। সেই থেকে বাউলগান বেছে নিই।
আপনার পড়াশোনা?
একেবারেই হয়নি। অভাবের কারণে করতে পারিনি। বাবা আমাকে বর্ণগুলোর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।
শুনেছি, আপনি অনেক বছর ধরে ফ্রান্সের প্যারিসেই থাকছেন। প্যারিসে গেলেন কবে?
১৯৮১ সালে। বয়স তখন ২৬-২৭। রেডিও ফ্রান্স আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। এর আগে ফ্রান্স টিভি থেকে বাউলদের ওপর একটা তথ্যচিত্র তৈরি করে। নাম সং অব দ্য ম্যাড ম্যান (পাগলদের গান)। গৌর ক্ষ্যাপা, রমানন্দ আর আমাকে নিয়ে। সঙ্গে আরও অনেক বাউল ছিলেন। তা দেখে রেডিও ফ্রান্স আমাকে আমন্ত্রণ জানায়। পরের বছর ১৯৮২ সালে আমন্ত্রণ জানায় ফ্রান্সের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়। এর পর থেকে প্রায় নিয়মিতই কলকাতা ও প্যারিসের মধ্যে যাওয়া-আসা হচ্ছে। বেশিটা সময় প্যারিসেই থাকছি।
আপনার খুব জনপ্রিয় একটি গান ‘বসুন্ধরার বুকে’।...
‘বসুন্ধরার বুকে’ আমার দাদার লেখা গান। বাংলা ১৩৮৫ সনে খুব বন্যা হলো। দুর্গাপূজার কদিন আগে কলকাতায় আমার একটা অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠান শেষে বাড়ির সবার জন্য নতুন কাপড় কিনেছি। এমন বৃষ্টি হলো যে সারা কলকাতায় বন্যা হয়ে যায়। ওই দিন ফিরতে পারিনি। ওদিকে দুর্গাপুরে আমাদের একটা মাটির ঘর ছিল। বৃষ্টি আর বন্যায় সেই ঘর ভেঙে যায়। বাড়ির সবাই স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ওই ঘটনাটি নিয়েই তৈরি হয়েছে এ গান।
আর ‘দিল কি দয়া হয় না’?
এই গান পেয়েছিলাম এক বাউলের কাছ থেকে। রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে তাঁর গানটি শুনেছিলাম। পরে তাঁর কাছ থেকে লিখিয়ে এনেছিলাম। গানটা কে লিখেছেন, আসল সুর কোনটা, তা জানি না। একটু খেয়াল করলে দেখবেন, এই গানটি কিন্তু আমিও বিভিন্ন সুরে গাই। কারণ, গানটা আমার খুব ভালো লাগে।
আপনাকে বাংলাদেশের শ্রোতারা প্রথম চিনেছে ‘রিয়েল সুগার’ অ্যালবাম দিয়ে। আপনার মোট কয়টি অ্যালবাম বেরিয়েছে?
১২টি। তবে কোনোটিই কলকাতা থেকে নয়, প্যারিস কিংবা লন্ডন থেকে। এর মধ্যে খুব উল্লেখযোগ্য হলো: রিয়েল সুগার (১৯৯৭), ইনার নলেজ (১৯৯৭), স্টেট বেঙ্গল ভার্সেস পবন দাস বাউল (২০০৪), টানাটানি (২০০৪)। বাংলাদেশে এসে তো আমি অবাক, আমার গান হরদম পাইরেসি হচ্ছে। এমন হলে শিল্পী বাঁচবে কী করে!
নতুন অ্যালবামের ব্যাপারে কী ভাবছেন?
ইতালির একটি ছেলে, নাম জুলিয়ানো। ইংল্যান্ডে থাকে। দুই বছর আগে কলকাতায় ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। বুদ্ধদেব দাশগুপ্তের কাছে গিটারের ওপর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। এখন তার সঙ্গে কাজ করছি। প্যারিস থেকে আসার আগে সাতটা গান তৈরি করেছি।
আপনি বাউলগানের সঙ্গে নানা ধরনের আধুনিক বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করেন। কেন?
আমার পছন্দ, তাই। অনেক অনুষ্ঠানে এ ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়। আমার উত্তর হলো, আমার গানের সঙ্গে কী বাজবে, তা আমি ঠিক করব। কারও পছন্দ না হলে শুনবে না। ডাকবে না আমাকে।
আপনি নিজেও অনেক বদলে গেছেন। এই পরিবর্তনটা ইতিবাচক বলে মনে করেন?
বাউল কিন্তু সব সময় পরিবর্তন করে গেছে। বাউলগানে কোনো গোঁড়ামি নেই। একটা সময় বাউলেরা গ্রামেগঞ্জে থাকত। সেই পরিবেশ অন্য রকম ছিল। সব বদলাচ্ছে, বাউল কেন বদলাবে না। পরিস্থিতি বাউলকে বদলে দিচ্ছে। বাউলের কোনো সঞ্চয় থাকে না, সব বিলিয়ে দেয়। এখন কিন্তু সঞ্চয়ের দরকার হচ্ছে। বাউলদের মূল কাজ হলো সাধনা। বাউল এখন খাবারের জন্য দৌড়াবে, নাকি সাধনা করবে?
আপনি ফতুয়া আর প্যান্ট পরে এসেছেন। কিন্তু গানের সময় অন্য পোশাক থাকে।
আমি গানের সময় লম্বা আলখেল্লা ব্যবহার করি। এটা আমার অনেক পুরোনো পোশাক। গানের মতো পোশাকটিও আমার একটা পরিচিতি। আমরা আমাদের সম্পদগুলো আজকের বিশ্বের নাগরিক সমাজে নিয়ে যাচ্ছি। পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। তবে পরিবেশনার ঢং একেবারেই পুরোনো।

দুপুরের খাবার খেতে হবে। সন্ধ্যায় ফ্লাইট। কলকাতায় যাচ্ছেন। সেখানে কদিন থাকার পর ফিরবেন প্যারিসে। সাক্ষাৎকার শেষ হলো। এবার ছবি তোলার পালা। বললেন, ‘সাক্ষাৎকারটি ছাপানোর পর পত্রিকাটি আমাকে পাঠিয়ে দেবেন। রেখে দেব।’
মেহেদী মাসুদ