সোমবার, ৩ অক্টোবর, ২০১১

বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আজকে একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে : আদিলুর রহমান খান

আদিলুর রহমান খান, মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর মহাসচিব এবং সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর আইন ভাঙার প্রবণতা, দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হওয়া, আইনের শাসন, গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের বিভিন্ন দিক নিয়ে কথা বলেছেন সাপ্তাহিক বুধবার-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন বুধবারের নিজস্ব প্রতিবেদক মঈনুল হক




বুধবার : পুলিশ একের পর এক নির্যাতন এবং নিপীড়নমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছে। বিরোধী দল আহূত হরতাল চলাকালীন সময়ে মতিঝিলে বিরোধীদলীয় কর্মীকে মধ্যযুগীয় কায়দায় নিপীড়ন করল।  কিন্তু পুলিশকে এই ধরনের কার্যক্রম থেকে বিরত রাখতে সরকারি কোনো উদ্যোগ নেই। সরকারের এই উদ্যোগহীনতাকে আপনি কিভাবে দেখেন?

আদিলুর রহমান খান : পুলিশ বাহিনীটাই তৈরি হয়েছিল ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির লাঠিয়াল হিসেবে। যা পাকিস্তানের নয়া উপনিবেশিক শাসনামলেও বজায় থেকেছে। একমাত্র ’৭১-এর জাতীয় মুক্তির সংগ্রামে অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে পুলিশ বাহিনীর একটা প্রধান অংশ যে গৌরবজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছিল, তা বেশি দূর অগ্রসর হতে পারেনি। কারণ স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই এই পুলিশ বাহিনীর ভেতর থেকেই স্পেশাল ব্রাঞ্চ নামে প্রতিষ্ঠান গঠন করা হয়। রাজনৈতিক কর্মীদের দমন-পীড়নের জন্য তাদের ব্যবহার করা হয়েছে। তখন জাতীয় রক্ষী বাহিনী গঠন করা হয়েছিল। ত্রিশ হাজার বামপন্থী নেতাকর্মীকে তখন হত্যা করা হয়েছে। এরপর বিভিন্ন সরকারের আমলে গোয়েন্দা বাহিনী আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করার নামে মানুষের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন চালিয়েছে এবং তার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। পুলিশ বাহিনী বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঠিক পথে পরিচালনা করার জন্য যে রাজনৈতিক সদিচ্ছা দরকার, তা আমাদের দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নেই। যদিও তাদের ঘোষণাপত্রে বিভিন্ন সময় ইতিবাচক কথা বলা হয়েছে, কিন্তু বাস্তবে তারা ক্ষমতায় আসার পরে জনগণ তাদের কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে দেখেনি। বর্তমান সরকার এর আগেও ক্ষমতায় ছিল এবং এখন যারা বিরোধী দলে আছেন তারাও ইতিপূর্বে ক্ষমতায় ছিলেন, কিন্তু জনগণের বন্ধু হিসেবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মধ্যে যে পরিবর্তনটা আনা দরকার ছিল তা তারা আনেননি।

বুধবার : নির্বাচনের আগে আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী ইশতেহারের পাঁচটি অগ্রাধিকারমূলক দফার একটিতে অঙ্গীকার করেছিল- আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোকে দলীয় প্রভাবমুক্ত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করে গড়ে তোলা হবে। ইশতেহারের আলোকে এবং মানবাধিকার প্রশ্নে পুলিশের বর্তমান কর্মকান্ড মূল্যায়ন করুন।

আদিলুর রহমান খান : মূলত এসব রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের সময় নির্বাচন পার করার জন্য ইশতেহার দেয়। এটা তারা কতটুকু বিশ্বাস করেন, তা নিয়ে জনগণের মধ্যে যথেষ্ট সংশয় আছে। শুধু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের কথা বলব না, বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময়ও বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচন হয়েছিল। যারা যতবার ক্ষমতায় এসেছেন তারা ততবার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েই নির্বাচন পার হয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কিন্তু বাস্তবে তারা সংস্কারের ক্ষেত্রে জনগণের পক্ষে যৌক্তিক যেসব উদ্যোগ নেওয়া উচিত, তা নিতে বারবারই ব্যর্থ হয়েছেন। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে বলব, স্বাধীনতার পর থেকে প্রতিটি সরকারের আমলেই মানবাধিকার পরিস্থিতি খারাপ থেকে খারাপতর হয়েছে। যা একটি ভয়াবহ অবস্থার দিকে বাংলাদেশকে ধাবিত করছে। আমাদের দেশে পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কোনোটিরই অবস্থান মানবাধিকারের ক্ষেত্রে সহায়ক নয়। পুলিশ নিয়ত রিমান্ডে নিয়ে মানুষকে নির্যাতনের সঙ্গে জড়িত। আমিনবাজারে ছয় জন ছাত্রকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় তাদের ভূমিকা ছিল। কোম্পানীগঞ্জে দেখা গেছে পুলিশের মধ্যে যারা অপরাধী, তারা একজনকে জনগণের মধ্যে ছেড়ে দিয়ে পিটিয়ে হত্যায় উদ্বুদ্ধ করেছে। এই বাইরে তো আমরা র‌্যাবের কর্মকান্ড দেখছি। যা আমাদের আবারো স্বাধীনতার অব্যবহিত পরের জাতীয় রক্ষী বাহিনীর কথাই মনে করিয়ে দেয়। পুলিশ বাহিনীর মধ্যে যদি একটা ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব না হয় এবং এদের মধ্যকার অপরাধী সদস্যদের চিহ্নিত করে তাদের বাহিনী থেকে বের করে না দেওয়া যায়, তাহলে এই পুলিশ বাহিনী জনগণের পক্ষের শক্তি হিসেবে কখনোই দাঁড়াতে পারবে না। এ থেকে বেরিয়ে আসার একটাই পথ হচ্ছে জনগণের সচেতন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ।

বুধবার : গণপিটুনি, বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী নানা কর্মকান্ড অব্যাহত রাখার পরও সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে সব কিছুকে আইনানুগ বলে দাবি করা হচ্ছে। যা দায়মুক্তির নামান্তর। এই অন্যায় দাবির ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?

আদিলুর রহমান খান : ভবিষ্যৎ প্রতিক্রিয়ায় অবশ্যই তাদের এই অন্যায় কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। যখন ২০০৮-এর নির্বাচনে নির্বাচিত হয়ে এই মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসেছিল, তখন ফেব্রুয়ারিতে জাতিসংঘের ইউপিআর সেশনে আজকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের ব্যাপারে সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ দেখাবে। কিন্তু তারপরও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড অব্যাহত রয়েছে। হেফাজতে এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন অব্যাহতভাবে চলছে। উচ্চতর আদালতের নির্দেশনা থাকার পরও রিমান্ডে নিয়ে নাগরিকদের নির্যাতন করা হচ্ছে এবং দেশে ভয়াবহতম একটা নির্যাতনের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। এখানে মানুষকে গুম করা হচ্ছে। এই পরিস্থিতি কোনো সভ্য ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে চলতে পারে না। বাংলাদেশের জনগণ যুগে যুগে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছে, লড়াই করেছে এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ও সরকারের পরিবর্তন এনেছে। তাই এই পরিস্থিতি বিরাজমান থাকলে জনগণ তার প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হবে।

বুধবার : পুলিশ নিজেই বেআইনি ঘটনা ঘটাচ্ছে, নিজেই তদন্ত কমিটি গঠন করছে এবং নিজেকে নির্দোষ দাবি করছে। এই স্ববিরোধিতা আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গতিপরায়ণ কি?

আদিলুর রহমান খান : এই স্ববিরোধিতা কখনোই আইনের শাসনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বরং এটা আইনের শাসনকে একটা অপশাসনে পরিণত করে। কারণ যারাই অপরাধী সেই অপরাধী চক্রই যদি আবার নিজেদের তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে নেয়, তাহলে অপরাধ করে যে কেউই পার পেয়ে যাবে এবং সেটাকেই বলা হয় দায়মুক্তি। এই দায়মুক্তি কোনোক্রমেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। আমিনবাজারে ছয় ছাত্র হত্যার ঘটনায় তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার পর বলা হয়েছে, অভিযুক্তদের ক্লোজ করা হলো। তার মানে হলো যে, দায়িত্ব থেকে কিছুদিনের জন্য প্রত্যাহার করা হলো। সাসপেন্ড করা হলো এবং পুলিশ কতখানি অপরাধী তা দেখা হবে বলে জানানো হলো। এর আগে কিন্তু কায়সার মাহমুদ বাপ্পীর ঘটনাতেও আমরা তদন্ত কমিটি হতে দেখেছি। এ্যাপোলো হসপিটালের স্টাফ আরিফের ক্ষেত্রেও তদন্ত কমিটি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বাস্তবতা হলো, তদন্ত কমিটি যেগুলো হয় সেগুলোর রিপোর্ট জনসমক্ষে খুব কমই প্রকাশিত হয় এবং তদন্ত কমিটি যে সুপারিশগুলো করে সেগুলো খুব কমই বাস্তবায়িত হয়। পুলিশের ব্যাপারে বা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্যান্য বাহিনীর সদস্যদের ব্যাপারে যে তদন্ত কমিটি হয়েছে, তার খুব কমই কিন্তু বাস্তবায়িত হয়েছে এবং সেটা না হওয়ার সংস্কৃতিও দায়মুক্তির সংস্কৃতি। এই দায়মুক্তির সংস্কৃতি বাংলাদেশের ওপর জোরেশোরে চেপে বসেছে। যদি সুষ্ঠুভাবে, নিরপেক্ষভাবে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করতে না পারে, তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা থাকবে না। তখন বাধ্য হয়ে মানুষ এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বিকল্প হিসেবে নতুন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলবে।

বুধবার : পুলিশ হেফাজতে প্রতিবছর বহু মানুষের মৃত্যু হচ্ছে। এছাড়া রিমান্ডের নামেও নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। এ ক্ষেত্রে উচ্চ আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশনা থাকলেও পুলিশ তা মানছে না। আদালতের নির্দেশনা লঙ্ঘনের এই প্রবণতা বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা হ্রাস করবে কি?

আদিলুর রহমান খান : আমাদের দেশে উচ্চতর বিচার আদালতের ২০০৩-এর নির্দেশনায় যে কথা বলা আছে তা নিম্ন আদালত একেবারেই গ্রাহ্য করছে না। রিমান্ডে নিয়ে কিভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে হবে সেই নির্দেশনা না মেনে তারা অনেকটা রাজনৈতিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে। যার ফলে উচ্চতর বিচার ব্যবস্থার প্রতি নিম্ন আদালতের কিছুসংখ্যক বিচারকের মনযোগ না দেওয়া এবং রাজনৈতিক স্বার্থে নির্দেশনা না মেনে চলা একটি ভয়াবহ আইনি সংকটের পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি করেছে। একটি বিষয় হচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে যদি কারোর মৃত্যু হয়, বা কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে যদি নির্যাতনের অভিযোগ প্রমাণ হয়, তা হলে অবশ্যই তা ফৌজদারি আইনের অধীনে পড়বে। কিন্তু আমাদের দেশের আইনি ব্যবস্থায় একটা সমস্যা রয়েছে যে, আপনি সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে মামলা করতে চাইলে আপনার অনুমোদন লাগবে। এই অনুমোদনটা সরকারের কাছ থেকে নিতে হয়। সরকার যখন সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অন্যায়-অবিচারকে প্রশ্রয় দেয়, তখন কিন্তু মামলা করার অনুমোদন আর পাওয়া যায় না এবং ক্ষতিগ্রস্তরা আইনের আশ্রয় নিতে পারেন না। বিভিন্ন তদন্ত কমিটি আমরা হতে দেখি এবং তদন্ত কমিটির ফলশ্রুতিতে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়াটা খুব দুরূহ হয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে দেশে আইনের শাসন যদি শক্তিশালী করতে হয়, তাহলে ফৌজদারি বিচার কার্যক্রমকেও শক্তিশালী করতে হবে। দুর্বল ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থা দিয়ে ন্যায্য বিচার পাওয়া কঠিন। যেখানে যারা অত্যাচারের শিকার হচ্ছেন অথচ তাদের রক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই, সেই রকম একটা পরিস্থিতি বজায় রেখে সাধারণ মানুষের পক্ষে আইনগত অধিকার আদায় করা সম্ভব নয়।

বুধবার : সারাদেশে পুলিশকে সরকার দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহারের এই প্রবণতার পরিণতি কি?

আদিলুর রহমান খান : এই প্রবণতা তো আজকে শুরু হয়নি। এটা অনেকদিন ধরেই চলছে। বিভিন্ন সরকারই পুলিশ বাহিনীকে দলীয় বাহিনী হিসেবে ব্যবহার করেছে এবং আজকের সরকারও করছে। এই প্রবণতার পরিণতি হচ্ছে যে, পুলিশ বাহিনীর প্রতি মানুষের অনাস্থা গড়ে উঠেছে এবং মানুষ তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্য, নিজেদের আত্মসম্মান, আত্মমর্যাদা এবং জান-মাল, সম্পত্তি রক্ষায় নিজেদের একটি প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গড়ে তুলবে। যা হবে এই আইনি কাঠামোর বাইরে একটি বিকল্প ব্যবস্থা। আমরা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের সময় দেখেছি, যখন এই সব প্রশাসন ব্যর্থ হয়ে গিয়েছিল, তখন জনগণ গণপ্রতিরোধ কমিটিগুলো গড়ে তুলে তাদের জান-মাল ও সম্পদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল। যদি আজকের পুলিশ জনগণের প্রতি আক্রমণকারী বাহিনীতে পরিণত হয়, তাহলে এই আক্রমণের বিরুদ্ধে জনগণ নিজেদের গণপ্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।

বুধবার : আইন-শৃঙ্খলা এবং জননিরাপত্তা রক্ষা করা পুলিশের কাজ। কিন্তু পুলিশ নিজেই যখন আইন ভঙ্গকারী হিসেবে আবির্ভূত হয় তখন সমাজে তার প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?

আদিলুর রহমান খান : পুলিশ নিজেই আইন ভঙ্গ করলে সমাজের মধ্যে আইনের শাসন বলতে আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না এবং সমাজের যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো আছে সে কাঠামোগুলোও তখন আর মানুষের কাছে আস্থার জায়গায় থাকে না। মানুষ তখন স্বভাবতই বিকল্প চিন্তা করতে থাকে এই কাঠামোগুলোকে পরিবর্তন করে জনগনের আস্থাভাজন কাঠামো গড়ে তোলার জন্য। মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমাদের আকাঙ্ক্ষা, রাষ্ট্রযন্ত্র এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের এখন যারা নিয়ন্ত্রণকারী তারা দেশকে ওই যায়গায় ঠেলে দেবেন না। যদি দেনই তাহলে এর বিকল্প কাঠামোও গড়ে উঠবে। ইতিহাস কোথাও থেমে থাকে না।

বুধবার : বর্তমান প্রেক্ষাপটে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিকে কিভাবে মূল্যায়ন করছেন?

আদিলুর রহমান খান : বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি আজকে একটি কঠিন সময় অতিক্রম করছে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশ কিন্তু ‘কনভেনশন এগেনেস্ট টর্চার’ স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ যদি জাতীয় অঙ্গনে অপরাধীদের শাস্তি দিতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে জবাবদিহিতার সম্মুখীন হতে হবে। বাংলাদেশ দ্বিতীয়বারের মতো জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছে কিছু অঙ্গীকারের ভিত্তিতে। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কিন্তু এই অঙ্গীকারের জবাবদিহিতা করতে হবে। আমাদের দেশে বারবার যারা ক্ষমতায় এসেছেন, তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন বলেই আজকের পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এর বিরুদ্ধে, যেটা আগেই বলেছি যে, জনগণের সচেতনতা, জনগণের সংগঠিত হওয়া এবং জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের মধ্য দিয়েই আমাদের দেশের মানবাধিকারের পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব।

বুধবার : আপনাকে ধন্যবাদ।

বুধবার, ২১ সেপ্টেম্বর, ২০১১

কয়েক মাসে বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তারা জনগণের সঙ্গে অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ করছেন : খনদকার নিয়াজ রহমান

খনদকার নিয়াজ রহমান, নগর পরিকল্পনাবিদ। বিশ্বব্যাংকের তত্ত্বাবধানে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট ব্যবস্থাপনা ও স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লানের পরিকল্পনাবিদ হিসেবে কাজ করেছেন। দেশের সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা, বিপর্যস্ত গণপরিবহন, ঢাকার যানজট এবং নগর পরিকল্পনা নিয়ে তিনি তার মতামত তুলে ধরেছেন সাপ্তাহিক বুধবারের কাছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বুধবারের নিজস্ব প্রতিবেদক মঈনুল হক

বুধবার : বর্তমান সময়ে সারাদেশের সড়ক এবং মহাসড়কগুলোতে বেহাল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এতে যাত্রী ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করেছে। সরকার সড়ক নির্মাণ এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করবে এটাই নিয়ম। তাহলে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো কেন?
খন্দকার নিয়াজ রহমান : এই প্রশ্নের উত্তর আমি দুটো অংশে দেব। প্রথমে কিছু নৈতিক প্রশ্ন তুলব। সবক্ষেত্রে শুধু টেকনিক্যাল দিকগুলো তুলে ধরায় রাষ্ট্র পরিচালনার যে নৈতিক দিক তা উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। নৈতিক দিকটির গুরুত্ব কমে যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। সংবিধান অনুযায়ী জনগণ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। তাদের চাওয়াই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। কিন্তু আমাদের মন্ত্রী ও আমলারা বোঝাতে চান যে, জনগণের চাওয়া আইনের মধ্যে না পড়ায় পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। তারা ভুলে যান যে, জনগণ মালিক। মন্ত্রী এবং আমলা জনগণের কর্মচারী। কয়েক মাসে বিভিন্ন মন্ত্রীর বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, তারা জনগণের সঙ্গে অবজ্ঞাপূর্ণ আচরণ করছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমরা দেখছি, ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ সড়কসহ দেশের বিভিন্ন সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। কয়েকটি এলাকার সঙ্গে রাজধানীর সড়ক যোগাযোগ বন্ধও হয়ে গেছে। এ বিষয়ে যোগাযোগমন্ত্রী জানালেন অর্থ বরাদ্দ না থাকায় এ অবস্থা হয়েছে। কিন্তু বাজেট এবং অর্থমন্ত্রীর বক্তব্য থেকে প্রতীয়মান হয় যে, যথেষ্ট টাকা দেওয়ার পরও কোনো কাজ হয়নি। আড়াই বছর ধরে যোগাযোগমন্ত্রী মেগা প্রজেক্ট নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। যার মধ্যে রয়েছে পদ্মাসেতু ও ঢাকা এক্সপ্রেসওয়ে। পদ্মাসেতু দেশের জন্য খুবই জরুরি। কিন্তু এখুনি এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের কোনো সুপারিশ বিশেষজ্ঞমহল থেকে না থাকলেও যোগাযোগ বিভাগ সেটা নিয়ে অনেক বেশি ব্যস্ত। এই প্রকল্পটি ৮/৯ হাজার কোটি টাকার। ফলে এই খাত থেকে যে লাভ আসবে তা সড়কের ছোটখাট রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত কাজের চেয়ে অনেক বেশি। এ কারণেই মন্ত্রী ও আমলারা মেগা প্রজেক্ট বাদ দিয়ে জনগণের প্রয়োজনীয় সড়ক সংস্কারে মনোনিবেশ করেননি বলে আমি মনে করি।
বুধবার : তিন অর্থবছরে সড়কখাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১৯ হাজার কোটি টাকার বেশি। এত পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকা সত্ত্বেও কেন সড়কপথের এমন বেহালদশা?
নিয়াজ রহমান : এর প্রথম কারণ হলো ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতা। ব্যবস্থাপনার প্রথম ধাপ হলো নেতৃত্ব। এক্ষেত্রে যোগাযোগমন্ত্রী সারাবছর যেদিকে ব্যস্ত থেকেছেন তার মন্ত্রণালয়ের আমলারাও সেই দিকটাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। বিশেষ করে সড়কে যে ফোরলেন প্রজেক্ট তা মূলত ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে বাস্তবায়িত হবে। কাজও ইতোমধ্যে অফিশিয়ালি শুরু হয়েছে। এর ফলে সড়ক সংশ্লিষ্টরা মনেই করেছিলেন লেনের টাকায় মেরামতের কাজও হয়ে যাবে। সেই অপেক্ষায় এতদিন ধরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বরাদ্দকৃত টাকার বেশিরভাগই বেহাত করা হয়েছে বলে আমার ধারণা।
বুধবার : বলা হয়ে থাকে সড়ক-মহাসড়কের বেহালদশার জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও প্রকৌশলীদের দায়িত্বহীনতা এবং দুর্নীতি দায়ী। এ বিষয়ে আপনি কি মনে করেন?
নিয়াজ রহমান : সরকারের রুলস অব বিজিনেসে একসময় মন্ত্রণালয়ের সর্বময় ক্ষমতা ছিল সচিবের হাতে। কিন্তু পরবর্তীতে মন্ত্রীকে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। ভালো-মন্দের দায় মন্ত্রীর ঘাড়েই পড়বে। মন্ত্রী বলতে পারেন না যে, তার সচিব বা প্রধান প্রকৌশলী দায়ী। তাদের দোষ থাকতে পারে। কিন্তু দায়িত্ব অবশ্যই মন্ত্রীকে নিতে হবে। দায়িত্ব আমলাদের ঘাড়ে চাপালেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না।
বুধবার : সড়ক খাতের দুর্নীতির বিষয় নিয়ে এখন অনেক আলোচনা হচ্ছে। একজন বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিষয়টি আপনি কিভাবে দেখেন?
নিয়াজ রহমান : দুর্নীতির বিষয়টি শুধু সড়ক খাতে নয় এটিকে সামগ্রিকভাবে দেখতে হবে। এই দেশটার মালিক যে জনগণ এই বোধটি আজকে আমাদের মন্ত্রী এবং আমলাদের মন থেকে মুছে গেছে। যার ফলে সড়কে মৃত্যু যখন গণহত্যার পর্যায়ে পৌঁছে গেছে তখন টাকা বরাদ্দ হয়েছে কি হয়নি তা নিয়ে তর্ক করতে তাদের বাধছে না। সৃষ্ট পরিস্থিতিতে তারা কোনো লজ্জাবোধ করছে না এবং অপরাধবোধে ভুগছে না।
বুধবার : সড়ক-মহাসড়কের অবস্থা নিয়ে দেশব্যাপী সমালোচনার ঝড় ওঠার পর এখন তাড়াহুড়া করে সংস্কার কাজ করা হচ্ছে। এতে মূল সমস্যার কতটা সমাধান সম্ভব?
নিয়াজ রহমান : আমরা দেখেছি মহাসড়কগুলো পানির নিচে ডুবে আছে। এই পানিতে এখন পাথর, বালু ফেলতে হবে। তারপর এর মধ্যে বিটুমিন দিতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এই কাজে গুণগত মান অর্জন করা সম্ভব হবে না। ফলে যে ইঞ্জিনিয়ার এবং কনট্রাক্টর এই কাজ করছে খুব শিগগিরই কাজটি তারা আবার পাবে। আর সবচেয়ে বড় কথা সড়কে যে সংকটকালীন অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা ইচ্ছা করে তৈরি করা হয়েছে। জরুরি পরিস্থিতিতে জরুরিভিত্তিতে কাজ করার মধ্য দিয়ে দুর্নীতির সুযোগ বেশি থাকে।
বুধবার : সম্প্রতি সড়ক দুর্ঘটনায় একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং একটি টেলিভিশনের প্রধান নির্বাহী থেকে শুরু করে চট্টগ্রামের ৪২ ছাত্রের মৃত্যুসহ অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। সড়কপথে দুর্ঘটনা বৃদ্ধির কারণ কি বলে আপনি মনে করেন?
নিয়াজ রহমান : সড়কে দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হচ্ছে, রাষ্ট্রের এই বিষয়ে মোটেও নজরদারি নেই। একটা মহাসড়কের নেটওয়ার্ক তৈরি করার পরে তার ব্যবস্থাপনা খুবই জরুরি। যে বড় বড় রাস্তা তৈরি হচ্ছে তার কিন্তু কিছু নিয়ম-কানুন আছে। ডিজাইন করার সময় ঠিক করা হয় সড়কে কি গতিতে গাড়ি চলবে, কোন কোন যায়গায় ওভারটেক করা যাবে, কোন কোন যায়গায় মানুষ রাস্তা পার হতে পারবে ইত্যাদি বিষয়। পরবর্তীতে সম্পূর্ণ অবহেলার সঙ্গে এই নিয়মগুলো ভঙ্গ করা হয়। রাস্তায় আইন মেনে চলার জন্য ৪০ বছরে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। হাইওয়ে পুলিশ বলে যারা আছে তারা কি দায়িত্ব পালন করে তা মানুষের জানা নেই। এই অবস্থায় আমাদের যোগাযোগ মন্ত্রণালয় হাইওয়েগুলোতে এক ধরনের গণহত্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েছে। বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার হিসাবে দেখা গেছে, ৫ বছরে দেশে সড়ক দুর্ঘটনায় ৬০ হাজার থেকে এক লাখ লোক মারা গেছেন। কোনো সভ্য দেশে মৃত্যুর পরিসংখ্যান এমন হতে পারে না। যেসব দেশে যুদ্ধ হচ্ছে সেসব দেশেই কেবল এই ধরনের পরিসংখ্যান পাওয়া যায়।
বুধবার : সরকারের একজন মন্ত্রীর চাপে কোনো পরীক্ষা ছাড়াই চালকদের পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ড্রাইভিং লাইসেন্সের ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক চাপকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেন?
নিয়াজ রহমান : আমি রাজনৈতিক চাপের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণভাবে যে প্রশ্নটি তুলতে চাই তা হলো, রাষ্ট্র একটি আইন দিয়ে পরিচালিত হতে হবে। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে যারা থাকবেন তাদের প্রথম কাজ হচ্ছে আইন-কানুন প্রয়োগ হচ্ছে কিনা এবং মানুষ মেনে চলছে কিনা তা দেখা। এক্ষেত্রে একজন মন্ত্রী নিজে কিভাবে প্রচলিত আইন ভেঙে লাইসেন্স দিতে বলেন? আরো বিস্ময়কর ব্যপার হচ্ছে, গণমাধ্যম যখন বিষয়টি নিয়ে আইনের কথা বলছে মন্ত্রী তখন ঔদ্ধত্যপূর্ণভাবে আইন লঙ্ঘনের পক্ষে বক্তব্য দিচ্ছেন। সরকারে যারা আছেন তারা যদি আইন ভঙ্গ করতে এত বেশি উৎসাহী হন, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় যাবে? আর তাছাড়া নৌমন্ত্রীর মর্জি মাফিক যদি ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া হয় তাহলে সড়ক-মহাসড়কে গণহত্যা আরো বাড়বে এটা নিশ্চিত।
বুধবার : ঢাকায় যানজট নিরসনে সিসিটিভি ক্যামেরা, লেনপ্রথাসহ নানা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। এখন আবার দড়ি টানিয়ে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। কেন ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
নিয়াজ রহমান : ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করা না যাওয়ার কারণটা খুবই সাধারণ। ঢাকায় এখন স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লান তৈরি করা হচ্ছে। এর আগে ১৯৯৮-৯৯ সালে ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট প্লান করা হয়েছে। এই প্লানগুলো তৈরির পর জাতীয় সংসদে পাস হয়। ফলে এগুলো কিন্তু আইন। এখন এই আইন প্রয়োগ করা এবং মেনে চলা পুলিশের দায়িত্ব। কিন্তু আমরা দেখছি এই আইন পুলিশসহ অনেকেই লঙ্ঘন করছে। তাহলে একটি আইন তৈরি করে যদি তা ভাঙার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে দায়িত্ব দেওয়া হয় তাহলে সমস্যা থেকে উত্তোরণ কখনোই সম্ভব হবে না। এখন ঢাকার ট্রাফিক ব্যবস্থা ঠিক রাখতে হলে শেষ যে পরিকল্পনা তৈরি হয়েছে তা ‘স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লান’। এই প্লানের সুপারিশ অনুযায়ী প্রচুর পরিমাণে ফুটপাত তৈরি করা এবং বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট প্রকল্প কার্যকর করা জরুরি। স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লানের প্রথম ফেসের সুপারিশ হওয়া সত্ত্বেও বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট কার্যকরে গড়িমসি করা হচ্ছে। এর কারণ বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট হয়ে গেলে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের আগ্রহের প্রজেক্ট ‘এক্সপ্রেসওয়ে’ প্রকল্পের যৌক্তিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। তাই এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরুর আগে হয়তো বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট হবে না। অথচ এক্সপ্রেসওয়ের বিষয়টি কিন্তু স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্লানের দ্বিতীয় পর্যায়ের শেষের দিকে উল্লেখ করা হয়েছে এবং এর সম্ভাব্যতা যাচাই করার কথা বলা হয়েছে।
বুধবার : সরকারি দলের কয়েকজন এমপিসহ সমাজের নানান অংশ ব্যর্থতার দায় নিয়ে যোগাযোগ ও অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করছেন। আপনার মতামত কি?
নিয়াজ রহমান : পদত্যাগের দাবির সঙ্গে আমি একমত। বিশেষ করে যোগাযোগমন্ত্রীর পদত্যাগের যে দাবি উঠেছে তা আমি শতভাগ সমর্থন করি। কিন্তু বাংলাদেশের সব সরকারের ক্ষেত্রেই যে মন্ত্রীর বিরুদ্ধেই ব্যর্থতার অভিযোগ উঠুক না কেন পদত্যাগের নজির নেই। কারণ তাদের মধ্যে যে জিনিসটা সবচেয়ে কম আছে সেটা হলো লজ্জা। তারা যদি ভাবতেন তাদের বেতন-ভাতা ও গাড়ি-বাড়ির একটা অংশ একজন রিকশাচালক, একজন দিনমজুরের কাছ থেকে আসে তা হলে কখনোই দেশে এই অবস্থার সৃষ্টি হতো না।
বুধবার : সার্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের অন্তরায় কি এবং কিভাবে এর সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন?
নিয়াজ রহমান : প্রধান অন্তরায় হচ্ছে আমাদের ব্যবসায়িক মহল। তাদের দাবি এবং চাপের কাছে সমগ্র জনগণের স্বার্থ বিসর্জন দেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় মাত্র দুই শতাংশ মানুষের কাছে ব্যক্তিগত গাড়ি আছে। কিন্তু এই গাড়ির চলাচল ও নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের বাইরে গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। যোগাযোগের ক্ষেত্রে শুধু সড়ক নয়। দক্ষ আরেকটি ব্যবস্থা হচ্ছে রেল। কিন্তু রেল সরকারি। ব্যবসায়ীদের মুনাফা এখানে অনেক কম। আর এ কারণেই এই খাতে সরকারের কোনো আগ্রহ নেই। দুই শতাংশ মানুষের ব্যক্তিগত গাড়িকে গুরুত্ব না দিয়ে যদি ৯৮ শতাংশ মানুষের গণপরিবহন ব্যবস্থার দিকে নজর দেওয়া হতো তা হলে যোগাযোগ ব্যবস্থা এমনভাবে ভেঙে পড়ত না। সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য মহাসড়কে লেন করতে হবে। বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট চালু করতে হবে, ব্যক্তিগত গাড়ি আমদানি নিরুৎসাহিত করতে হবে এবং সড়কের পাশাপাশি রেলের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। রাজধানীর পরিবহন ব্যবস্থার কথা যদি ধরা হয় তাহলে বলব, কোনো প্রকার নিয়মনীতি ছাড়াই ৫০ লাখ লোকের রুটিরুজির রিকশাকে রাস্তা থেকে জোর করে তুলে দেওয়া হচ্ছে। অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে এমন যে, পুলিশের প্রধান বা মন্ত্রীর ইচ্ছা হলেই বিপুলসংখ্যক মানুষের পেটে লাথি মারা যায়। এখন আমি জনগণকে আহবান জানাব তারা যেন একটি দাবি তোলেন যে, সপ্তাহে অন্তত একদিন ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তায় বের করা বন্ধ রাখতে হবে। এটা যদি করা যায় তাহলে এক মাসের চার দিনে মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে ট্রাফিক ব্যবস্থার সমস্যা কোথায়। মানুষ জেনে যাবে ঢাকায় মাত্র দুই শতাংশ মানুষের জন্য ৯৮ শতাংশ মানুষের জীবন ওষ্ঠাগত।
বুধবার : আপনাকে ধন্যবাদ।

মঙ্গলবার, ২৩ আগস্ট, ২০১১

আদালতে গেলে শোনা যায় আওয়ামী লীগ বেঞ্চ, বিএনপি বেঞ্চ, জামায়াত বেঞ্চ। এগুলো কি শুনতে ভালো লাগে! এভাবেই আমাদের বিচার বিভাগ চলছে : ব্যারিস্টার রফিক-উল হক

সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক। উচ্চআদালতে চলমান অস্থির অবস্থা, বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ, দলীয় বিবেচনায় বিচার বিভাগে নিয়োগসহ আদালত প্রাঙ্গণের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন সাপ্তাহিক বুধবার-এর সঙ্গে। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন – আহম্মদ ফয়েজ
বুধবার : মঙ্গলবার উচ্চতর আদালতে বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের নেতৃত্বে একটি অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মামলা ও গ্রেফতারের ঘটনা ঘটেছে এবং আদালত প্রাঙ্গণ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে। উচ্চতর আদালতে এ ধরনের ঘটনার পেছনে কি কারণ থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
ব্যারিস্টার রফিক-উল হক : আদালতে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার প্রধান কারণ, আমার কাছে মনে হয়েছে, আইনজীবী এবং আদালত দুইয়েরই ধৈর্যের অভাব। তাদের ধৈর্য না থাকায় এই ছোটখাটো বিষয় থেকে এমন ঘটনার জন্ম হচ্ছে। এখানে একটা বিষয় হচ্ছে আইনজীবীদের মধ্যে যেমন দলীয় রাজনীতি রয়েছে, তেমনি আমার ধারণা, কিছু আদালতও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। আদালত যদি নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে আইনজীবীরাও নিরপেক্ষ এবং শান্ত থাকতে পারেন না। আইনজীবীরা উত্তেজিত হয়ে যান। এই পরিস্থিতির জন্য আইনজীবীরা যেমন দায়ী, তেমনি কিছু আদালতও দায়ী। আদালত যদি ইন্ধন না যোগাত তাহলে আইনজীবীরাও এরকম আচরণ করতে পারত না। ওই ঘটনায় আদালত যেসব মন্তব্য করেছে, সেগুলো ইস্যুর বাইরে ছিল। সেদিন আমিনী ইস্যু ছিল কিন্তু অন্য কেউ তো ইস্যু ছিল না। যারা ইস্যু নয়, তাদের সম্পর্কে অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য করার কি দরকার! এই মন্তব্য যারা মেনে নিতে পারেননি, তাদের ধৈর্য ধারণ করা উচিত ছিল, কিন্তু তারা উত্তেজিত হয়ে গেছেন। আদালত যদি মন্তব্যের পর কোনো অর্ডার দিত তাহলে ওই আইনজীবীরা আপিল বিভাগে যেতে পারতেন। আইনি প্রক্রিয়ায় থেকেই এগুনো সম্ভব হতো, কিন্তু সেটা না করে, আদালতে মারমুখী হওয়াটা তো উচিত হয়নি। এ ধরনের ঘটনা কারো জন্যই সুখকর নয়। বিচারকদের জন্যও নয়, আইনজীবীদের জন্যও নয়। যারা সংশ্লিষ্ট নয় তাদের সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করা আদালতের জন্য উচিত নয়। আর যে কোনো ঘটনাতেই আইনি প্রক্রিয়ায় এগুনোই আইনজীবীদের কাজ হওয়া উচিত। আমি ব্যক্তিগতভাবে এসব ঘটনা খুবই অপছন্দ করি। আদালতে মারামারি, যুদ্ধংদেহীভাব কখনোই ভালো নয়। এগুলো কারো কাছেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। গণতন্ত্রের জন্য লড়াই হতে পারে, মানবিকতার জন্য লড়াই হতে পারে। কিন্তু যা ঘটল তা কেন হবে!
বুধবার : ২০০৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির কার্যালয় ভাংচুর করেছে। এছাড়া বিভিন্ন সময় আদালত প্রাঙ্গণে সমাবেশ ঘটিয়ে আদালতকে হুমকি প্রদানের ঘটনাসহ এমন বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। ২০০৬ সালের ঘটনায় জড়িতরা পরবর্তীতে এই আদালতেরই বিচারকও হয়েছেন এবং রাষ্ট্রের আইন কর্মকর্তার পদেও নিয়োগ পেয়েছেন। এই প্রবণতাকে আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
রফিক-উল হক : সেই সময় যারা গোলমালের সঙ্গে জড়িত ছিলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের কাউকেই চিনি না। যারা এখন বিচারক হয়েছেন, কি ছিলেন তারা, কোন পার্টি করতেন, এসবের কিছুই আমি জানি না। তবে এই প্রবণতাটা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে এর চাইতে খারাপ কিছুই হতে পারে না। এটা ভয়ঙ্কর এক প্রবণতা। আমি খুবই সচেতনভাবে এই বিষয়টিকে অপছন্দ করি। এই ধরনের ঘটনার সঙ্গে কখনোই একমত পোষণ করা যায় না। একজন বিচারক নিয়েগের ক্ষেত্রে অবশ্যই এই আস্থাটা থাকা জরুরি, যার ফলে একজন বিচারকের রায় মেনে নিতে কোনো মানুষের দ্বিধা কাজ করবে না। কিন্তু যা হয়েছে এমন ঘটনা আইনি কাঠামো, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা এবং গণতন্ত্রকে ক্ষুণ্ণ করবে। এসব করা হলেই এই সিস্টেমগুলো ভেঙে পড়বে। এভাবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বিচারকরা আইনানুগতভাবে যা ইচ্ছে তাই করবেন, আইনজীবীরাও আইনানুগভাবে যা ইচ্ছে তাই করবেন, কিন্তু কিসের জন্য এসব করা হবে এমন কোনো লক্ষ্য স্থির না থাকলে সব কিছুতেই ঝামেলা হয়ে যাবে।
বুধবার : দলীয় বিবেচনায় ও জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘনের মাধ্যমে বিচারকসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগের নেতিবাচক প্রভাব কি হতে পারে বলে আপনার কাছে মনে হয়?
রফিক-উল হক : যেসব ঘটনা এখন ঘটছে, এগুলোই তো নেতিবাচক প্রভাব। দলীয় নিয়োগের ফলেই তো এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে। বিচারক যদি নিরপেক্ষ হতো তাহলে নিশ্চই এই ধরনের ঘটনা ঘটতো না। আমার সবচেয়ে খারাপ লাগে, যখন দেখি, কিছু আইনজীবী সরাসরি রাজনীতি তো করেই, কিছু আইনজীবী আছে রাজনীতি করেন না কিন্তু রাজনীতির জন্য পরিচালিত হন গোপনে। এখন বিষয় হচ্ছে স্বাধীন বিচার ব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠিত করা তো শুধু আইনজীবীদের দায়িত্ব নয়, এটা বিচারকদেরও দায়িত্ব। দেখা যাচ্ছে জামিনের জন্য যাওয়ার পর, আদালত যে আগুনে পানি ঢালবে সেখানে তেল ঢালছে। বিচারকরা এটাকে অনেক বড় ক্রেডিট হিসেবে দেখছেন। অন্য যায়গায় বাহ বাহ পাবেন। কিন্তু এটাতো ভালো নয়। বিচারক এবং আইনজীবী দু’জনই বিচার ব্যবস্থার অংশ। আইনের সুশাসন প্রতিষ্ঠার স্বার্থে এখানে দু’জনেরই কর্তব্য রয়েছে। এর মধ্যে একে অপরের সহযোগিতায় না এগুলে চলবে কি করে! আমি আইনজীবী যদি ভুল করি আপনি বিচারক সে ভুলে আগুন দেবেন না। এজন্যই রাজনৈতিক নিয়োগের মাধ্যমে এবং রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট বিচারককে নিয়োগ দেওয়া ঠিক না। এখানে এমন লোক নেওয়া দরকার, যারা কখনোই দলীয় রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নন। এই ধরনের লোক পাওয়া অবশ্য কঠিন, কিন্তু সর্বোচ্চ চেষ্টাটুকু তো থাকা লাগবে। খারাপের মধ্যে হলেও ভালো খুঁজে বের করতে হবে।
বুধবার : প্রচলিত ধরনের নিয়োগের পেছনে রাজনৈতিক অভিপ্রায় কতটুকু বলে আপনি মনে করেন?
রফিক-উল হক : দেখা যায় সরকার নিজেদের সুবিধার কথা চিন্তা করে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দিচ্ছে। এবারো তাই ঘটলো, জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করে একজনকে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ দেওয়া হলো। যে বিচারকের জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা হলো তিনি ব্রিগেডিয়ার (অবঃ) হান্নান শাহের ভাই। তাকে নিয়োগ দিলে আবার কি হয় এই চিন্তা থেকেই তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন বলছে অন্য কথা। সে নাকি অসুস্থ। আরে কিসের অসুস্থ? আমি তার চেয়ে অনেক বেশি অসুস্থ। আমি কাজ করছি না? এখন এসব অজুহাত দিয়ে দেশটার বারোটা বাজিয়ে তো কোনো লাভ নেই। আসলে এই বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় রাজনৈতিক অভিপ্রায় কাজ করছে। এটা খুব খারাপ প্রবণতা। বিচারপতি যিনি হবেন সেখানে কার ছেলে, কার ভাই, কার আত্মীয় এসব বাদ দিয়ে কোয়ালিটি দেখতে হবে। তিনি মানুষ হিসেবে সৎ কিনা, কাজের জন্য যোগ্য কিনা, এসব বিষয় অগ্রাধিকার দিতে হবে। তা না করে যার যেভাবে সুবিধা হচ্ছে সেভাবে যদি করে সেটা কিন্তু ঠিক নয়।
বুধবার : রাষ্ট্রের তিনটি স্তম্ভের একটি হচ্ছে বিচার বিভাগ। এই বিভাগের বর্তমান অবস্থাকে আপনি কিভাবে দেখছেন?
রফিক-উল হক : আমরা তো বলেই চলেছি স্বাধীন বিচার বিভাগ চাই। সরকারও জানে, এই নিয়ে কত কি হলো। ২০০৭ সালের নভেম্বর থেকে স্বাধীন বিচার বিভাগ করা হলো। তখন ঢোল পিটিয়ে এসব প্রচারও করেছে। কিন্তু এগুলো তো মুখের কথা। আসলে স্বাধীন বিচার বিভাগ নির্ভর করে যিনি বিচারক তিনি কতটুকু নিজের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করতে পারেন তার ওপর। উচ্চ আদালতের কোনো বিচারকের তো চাকরি যাওয়ার সুযোগ নেই। তাহলে কেন তিনি স্বাধীন হবেন না। পিছনের লোকগুলোকে খুশি করার জন্যই তিনি স্বাধীন থাকেন না। আরেকটা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হওয়ারও একটা লোভ কাজ করতে পারে। যে বিচারক শেষ অবসরে থাকবেন, তিনিই হবেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। এই বিষয়টা বিচার বিভাগের জন্য যে কত বড় ক্ষতিকর সেটা বোঝাটাও বেশ কঠিন। এই ব্যবস্থাটি না থাকলে ওয়ান-ইলেভেনও হতো না।
বুধবার : সাম্প্রতিককালে আদালতের কিছু রায় নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই বিতর্কের কারণ কি? আদালতের এই রায়গুলো কতটা যথাযথ ছিল?
রফিক-উল হক : রাজনৈতিক বিতর্কের পিছনে আসলে যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। যেসব রায় নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলছে, সেখানে দেখা যাচ্ছে ওইসব রায় ভালো করে রাজনৈতিক দলগুলো দেখেইনি। তারা রাজনৈতিক কারণেই রাজনৈতিক বিতর্কের দিকে যাচ্ছে। আর রায়ের যৌক্তিকতা কিংবা যুক্তিহীনতার বিষয়ে কিছু বলার নেই সেভাবে। আদালতের তো যেটা মন চাচ্ছে সেটাতেই একটা অর্ডার দিয়ে বসছে। এগুলো এক ধরনের অপ্রয়োজনীয় কাজ। রায় যখন হয়, বিচারক যখন কথা বলেন, সেগুলোই আইন। কিন্তু এই আইন চিরকাল থাকে না। এগুলো সময়ের প্রেক্ষাপটে, রাজনীতির প্রেক্ষাপটে এবং বৈশ্বিক অবস্থার ওপর নির্ভর করে পাল্টে যায়। আমাদের বিচারকরা এখন আইনের বিচার না করে দেখে মানুষটা কে, সময়টা কি। এসব কারণে সব বিষয় খুব বেশি সাংঘর্ষিক হয়ে যায়। এগুলো মেনে নেওয়া যায় না। এসবের মাধ্যমে দেশটাকে একটা অস্থির পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। আমরা এমনটি মোটেও আশা করিনি। সুপ্রিমকোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশন এর বিরোধিতা করছে। আরো অনেকেই করেছে। আমি নিজেও এই ধরনের কর্মকান্ডের বিরোধী।
বুধবার : অনেক আইনজীবী অভিযোগ করেন, আদালতের এই বেঞ্চ এই দলের, ওই বেঞ্চ ওই দলের। এই অভিযোগগুলো কেন আসে?
রফিক-উল হক : এই প্রবণতাটা গত কয়েক বছর ধরে চলে আসছে। আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে বেঞ্চগুলো অঘোষিতভাবেই আলাদা হয়ে গেছে। আদালতে গেলে শোনা যায় আওয়ামী লীগ বেঞ্চ, বিএনপি বেঞ্চ, জামায়াত বেঞ্চ। এগুলো কি শুনতে ভালো লাগে! এভাবেই আমাদের বিচার বিভাগ চলছে। এর চাইতে দুঃখের আর কিছু নেই। এভাবে তো আর চলতে পারে না, একদিন না একদিন এ অবস্থার উন্নতি হবে। মানুষ আর কত নিচে নামবে! নামতে নামতে আমরা অনেক নিচে নেমেছি, এবার ওঠা ছাড়া উপায় নেই।
বুধবার : সম্প্রতি আদালতের একটি সংক্ষিপ্ত রায়ের ওপর ভিত্তি করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে। আদালতের সংক্ষিপ্ত এই রায়ে দুটি দিক থাকলেও সরকার গ্রহণ করেছে একটি। এর কারণ কি হতে পারে, আর আদালতের রায়টি এখনো পূর্ণাঙ্গ না আসারই বা কি কারণ থাকতে পারে?
রফিক-উল হক : এই রায়টি না দেখেই সরকার একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে। আদালতের যে সংক্ষিপ্ত রায় সেখানে বলা আছে পূর্ণাঙ্গ রায় ফলো করার জন্য। কিন্তু এখন যে কাজটি হয়ে গেল সেটি কিসের ওপর ফলো করে হয়েছে। ওই সংক্ষিপ্ত রায়টিও তো পুরোপুরি মানা হয়নি। এই কাজটি প্রধানমন্ত্রীর করা উচিত হয়নি। তার কাছ থেকে আমরা এসব আশা করি না। তিনি তো ‘বঙ্গবন্ধু’ কন্যা। তার রক্তে রাজনীতি। তিনি কি করে এমন একটা কাজ করে বসলেন। যেখানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ছাড়া কোনোভাবেই চলা সম্ভব না, সেখানে তিনি পুরো ব্যবস্থাটাকেই আদালতের দোহাই দিয়ে বাতিল করে দিলেন।
আদালত এমন একটি স্পর্শকাতর বিষয়ে যে সংক্ষিপ্ত রায় দিয়ে বসে আছে এটাও ঠিক হচ্ছে না। এই রায়টি কেন এখনো পূর্ণাঙ্গভাবে এলো না – তা আমার কাছে বোধগম্য নয়।
বুধবার : বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের সুদূরপ্রসারী প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে?
রফিক-উল হক : বিচার বিভাগের ওপর রাজনৈতি প্রভাব যদি অব্যাহত থাকে তাহলে বিচার বিভাগ চূড়ান্তভাবে ভেঙে পড়বে। বিচার বিভাগ রাষ্ট্রের একটা অঙ্গ, এই অঙ্গটি হচ্ছে মাথা। মাথাই যদি ভেঙে পড়ে তাহলে আর কিছুই রইলো না। এটা নিয়ে যেন কারোরই কোনো মাথা ব্যথা নেই। কিন্তু বিষয় হচ্ছে এই দেশটাকে তো আমাদেরই রক্ষা করতে হবে। কেউ এসে তো এই কাজ করে দিয়ে যাবে না।
বুধবার : বিসমিল্লাহ, রাষ্ট্রধর্ম, ধর্মীয় রাজনৈতিক দল রেখেই সরকার সংবিধান সংশোধন চূড়ান্ত করেছে। এই বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
রফিক-উল হক : এখানে কথা হচ্ছে রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম হয়? রাষ্ট্র কি নামাজ পড়ে, রোজা করে, নাকি পূজা করে? রাষ্ট্রের ধর্ম হবে কেন? রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম হয় না। ধর্ম হয় মানুষের। এটা এরশাদের আমলে হয়েছে। এরশাদ রাজনৈতিক সুবিধা হাসিলের জন্যই এ কাজ করেছিলেন। তিনি মনে করেছিলেন, আকর্ষণীয় কিছু করতে হবে, সেজন্যই হয়তো করেছেন। সে সময় কি করেছিল এরশাদ তা কেউ চিন্তাই করতে পারবে না। আমি নিজে ছুটে গিয়েছিলাম তার কাছে। তাকে বললাম রাষ্ট্রের ধর্ম কিভাবে হয়? এখানে তো মুসলমান ছাড়াও অন্যান্য জাতি-ধর্মের লোকেরা বসবাস করে। তখন তিনি এর সঙ্গে যোগ করেছেন তবে অন্যান্য ধর্মের লোকেরাও নিজ নিজ ধর্ম পালন করবে। এবারো শেখ হাসিনা সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে পারেননি।
বুধবার : আপনাকে ধন্যবাদ।

বুধবার, ২৭ জুলাই, ২০১১

শিক্ষা নারীকে ক্ষমতা দিচ্ছে। সেই ক্ষেত্রটা যদি আক্রান্ত হয় এর চেয়ে হতাশার ব্যাপার আর থাকে না : সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, সমাজ বিশ্লেষক, লেখক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরিটাস। সম্প্রতি ভিকারুননিসা স্কুল শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রীকে যৌন নির্যাতন, নানা ধরনের সামাজিক অবক্ষয়ের কারণ ও এসব বিষয়ে শাসকশ্রেণীর আচরণের বিভিন্ন দিক নিয়ে তিনি কথা বলেছেন সাপ্তাহিক বুধবারের সঙ্গে। প্রবীণ এই শিক্ষাবিদের সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন বুধবারের নিজস্ব প্রতিবেদক আহম্মদ ফয়েজ বুধবার : আপনি একজন শিক্ষাবিদ। দীর্ঘকাল শিক্ষকতার সঙ্গে জড়িত। কিছুদিন ধরে, কতিপয় শিক্ষক তারই ছাত্রীদের ওপরে যৌন নির্যাতনের ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আপনি এই পরিস্থিতিকে কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
প্রফেসর সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : আমি এটাকে ভয়ঙ্কর একটা পরিস্থিতি মনে করছি। আমার রক্ত হিম হয়ে যায় যখন আমি শুনি, একজন শিক্ষক তার ছাত্রীর ওপরে এই নির্যাতন করছে। এই শিক্ষক প্রকৃত শিক্ষক নয় এটা আমি মনে করলাম। কিন্তু আমার কাছে প্রশ্ন জাগে কেমন করে সে এই শিক্ষকতায় এলো। কেমন করে শিক্ষক এই ধরনের কাজ করে? কোন প্রবৃত্তি থেকে সে এই কাজ করে? এরকম প্রবৃত্তি কেন হয়? এই ধরনের কাজের ব্যাখ্যা সোজা। এসব শিক্ষক নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছে। কোচিংয়ের নাম করে ছাত্রীদের নিয়ে যাচ্ছে, ছাত্রীদেরও যেতে হচ্ছে। এটা তো আছেই। কিন্তু এর মূল ব্যাপারটা হচ্ছে একটা ব্যাধি। এই ব্যাধি আমাদের সমাজে ঢুকেছে। আমাদের সমাজ ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। এটা অস্পষ্ট করে কোনো লাভ নেই। এই ব্যাধিটার নাম হচ্ছে পুঁজিবাদ। আমরা দু’বার বড় দুটি আন্দোলনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র বদল করেছি। কিন্তু আমরা সামাজিক রাষ্ট্রিক ব্যবস্থা বদল করতে পারিনি। রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল কাঠামোটা রয়েই গেছে। ক্ষমতায় এ আসছে ও যাচ্ছে। কিন্তু ওই যে সমাজ ব্যবস্থা, এই সমাজ কিন্তু পুরনো সমাজ ব্যবস্থা। আমরা ’৭১-এর যুদ্ধকে মুক্তিযুদ্ধ বলি। কারণ আমরা আশা করেছিলাম, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রেরই কেবল বদল হবে না, সমাজেরও বদল হবে। সামাজিক বিপ্লব ঘটবে এবং এই সমাজ মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর স্বীকৃতি দেবে, নিরাপত্তা দেবে এবং মানুষের সুযোগ-সুবিধাগুলো নিশ্চিত করবে। কিন্তু সেটা হয়নি।
বুধবার : সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটেছে ভিকারুননিসা নূন স্কুলে। এই অভিযুক্ত শিক্ষককে রক্ষা করার জন্য প্রভাবশালী ব্যক্তিরা সক্রিয় রয়েছেন বলে শোনা যাচ্ছে। শিক্ষাঙ্গনকে পবিত্র স্থান হিসেবে ধরা হয়। শিক্ষাঙ্গনে এই ধরনের আচরণ সামাজিক প্রেক্ষাপটে কতটা বিপজ্জনক বলে আপনার কাছে মনে হয়?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : মানুষ তার দৈনন্দিন জীবিকার কাজে এতটাই ব্যস্ত যে, এর প্রতিবাদ বা প্রতিরোধের বিষয়ে মোটেও ভাবে না। কাজেই এই ঘটনাটা একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ঘটনা বহুই ঘটেছে, কিন্তু এই ঘটনাটি চরম ঘটনা। এরকম তো আমরা আর দেখিনি। যারা কর্তাব্যক্তি তারা এটা জেনেও এটাকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। ওই দুর্বৃত্ত শিক্ষককে বাঁচানোর চেষ্টা করছে। বিপদ ছিল মেয়েটার, মেয়েটার পরিচয় প্রকাশ পেলে সামাজিকভাবে হেয় হবে, সে এবং তার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কিন্তু ঘটনাক্রমে এই মেয়েটা অত্যন্ত সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে। সে নীরবতা ভঙ্গ করেছে। এই দুর্বৃত্ত চিহ্নিত হয়েছে, তার শাস্তি আমরা দাবি করছি। শাস্তি হবে হয়তোবা, কারণ বিষয়টি অনেক বেশি আলোচনায় চলে এসেছে। কিন্তু শুধু একজন দুর্বৃত্তকে শাস্তি দিয়ে তো আমরা যে ব্যাধিটা রয়ে গেছে সেই ব্যাধিটা দূর করতে পারব না। কাজেই এসব প্রতিরোধের আন্দোলন যেটা হচ্ছে নানা ক্ষেত্রে, আমাদের জাতীয় সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে, পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে, নির্যাতন প্রতিরোধে যে আন্দোলন হচ্ছে, সব কিছুই কিন্তু ইঙ্গিত করে সমাজ একটা অসুস্থ এবং বিকারগ্রস্ত সমাজ। এর চিকিৎসা শুধু উপশম দ্বারা হবে না, এর নিবারণ করতে হবে এবং সমাজের মধ্যে একটা মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। যেই সমাজ গণতান্ত্রিক হবে এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
বুধবার : ইতিপূর্বে যৌনসন্ত্রাসের যে ঘটনাগুলো ঘটেছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত দৃষ্টান্তমূলক কোনো শাস্তির ব্যবস্থা হয়নি। রাষ্ট্রের এই দায় মুক্তির কারণেই এ ধরনের ঘটনা ক্রমাগত বাড়ছে বলে মনে করেন কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : এটা তো অবশ্যই। যদি দুর্বৃত্তদের শাস্তি হতো তাহলে তারা ভয় পেত। তাদের তো শাস্তি হয় না, জানা যায় না কি ঘটলো। এ কারণেই অন্য দুর্বৃত্তরা আবার সাহস পায়। রাষ্ট্র কোনো মতেই দায় মুক্ত হতে পারে না। দায় তো রাষ্ট্রকেই নিতে হবে।
বুধবার : এসব ঘটনার জন্য রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার পেছনে সরকারের ব্যর্থতা কতটুকু বলে মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : শেষ পর্যন্ত দায়িত্ব তো সরকারের ওপরেই। সরকারের ব্যর্থতাই রাজনৈতিক ব্যর্থতা। সরকারকে এখানে দেখতে হবে, প্রশাসনিক ব্যর্থতার কারণ কি? সরকার যদি কোনো রাজনৈতিক কারণে এসবের বিচার না করে বা পক্ষপাতিত্ব করে তাহলে এটা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। সর্বশেষ ঘটনায়ও একটা রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কথা শোনা গেছে। এটাকে উন্মোচন করতে হবে।
বুধবার : ভিকারুননিসার এই ছাত্রী কোচিং সেন্টারেই লাঞ্ছনার শিকার হয়েছেন। তার আগে কোচিং সেন্টারে নানা ধরনের অপকর্মের অভিযোগ এসেছে। স্কুলের শিক্ষকদের আলাদা করে কোচিং পাড়ানোর বিষয়টিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : কোচিং সেন্টার সম্পর্কে আমাদের অনেক অভিযোগ আছে। তারা প্রশ্নপত্র ফাঁস করে দেয়, ভর্তির বিষয়ে অবৈধভাবে সহযোগিতা করছে। কিন্তু যৌন হয়রানির বিষয়টি কিন্তু এতদিন আর এভাবে ধরা পড়েনি। তবে এটা চলছিল, কেউ কেউ বলছিল। কোচিংয়ের শিক্ষকরা সুযোগ নেয়। ক্লাসে তারা পড়ায় না। ক্লাসরুমে পর্যাপ্ত শিক্ষা দেওয়া হয় না বলেই শিক্ষার্থীরা কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে। জানা গেছে, এসব দুর্বৃত্ত শিক্ষক প্রলোভন দেয় কোচিং সেন্টারে গেলে তারা প্রশ্ন বলে দেবে, নম্বর বাড়িয়ে দেবে। এমনকি প্রশ্ন তৈরিও হচ্ছে কোচিং সেন্টারে। এটা একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার। ঘটনা ঘটছে পুঁজিবাদের কারণে। পুঁজিবাদ সব কিছুকে পণ্যে পরিণত করছে। স্বাস্থ্যসেবা পণ্যে পরিণত হয়েছে, শিক্ষাও এখানে পণ্যে পরিণত হয়েছে। আজকে এই পণ্যের জন্য আর্থিক মূল্য তো দিতেই হয়, তাকে অন্য মূল্যও দিতে হয়। আজকে দেখা যাচ্ছে শিক্ষা নামক পণ্যটি ক্রয়ের জন্য সম্মান এবং সম্ভ্রম হারানোর মতো মূল্যও দিতে হচ্ছে। তাই আমার পরিষ্কার দাবি হচ্ছে- কোচিং সেন্টার অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। এটার জন্য সরকারি পদক্ষেপ দরকার এবং অভিভাবকদের এগিয়ে আসতে হবে। এই বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত অল্প কয়েকজন দুর্বৃত্ত শিক্ষক। অধিকাংশ শিক্ষকই আমি মনে করি এর বিরোধী। এই কিছু শিক্ষকের কারণে গোটা শিক্ষক সমাজের বদনাম হচ্ছে।
বুধবার : আপনি সার্বিক বিষয়টিকে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের প্রেক্ষাপটে কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : এটা যে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় সেটা আমরা সবাই জানি। এই ঘটনার মধ্য দিয়ে সমাজের যে ভয়াবহ পরিস্থিতি তার উন্মোচন ঘটলো। আমরা জানি মেয়েরা কোথাও নিরাপদ নয়, রাস্তায় নিরাপদ নয়, বাড়ির ভিতরে নিরাপদ নয়, এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও তারা নিরাপদ নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষক থেকে শুরু করে, স্কুলের ছাত্রীও নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। স্কুলের ছাত্রীর নিরপত্তাহীনতার ঘটনাটা সবচেয়ে মারাত্মক। কারণ এই ছাত্রী যে প্রতিষ্ঠানে গিয়েছে, যার কাছে গিয়েছে এবং যার কাছে সে সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তা প্রত্যাশা করে সেই যদি তার অনিরাপত্তার কারণ হয়ে যায় তাহলে ছাত্রীরা যাবে কোথায়? শিক্ষকের দায়িত্ব তার ছাত্রীকে রক্ষা করা, সেই জায়গায় যদি শিক্ষকই নিপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় তাহলে কি দাঁড়ায়? এমন অনেক ভক্ষকই আমাদের সমাজে শিক্ষক হয়ে গেছেন। আমরা সমাজে বা রাষ্ট্রে যাদের রক্ষক হিসেবে দেখতে চাই, তারা ভক্ষকের ভূমিকায় চলে যাচ্ছে। আবার নানা কারণে দেখা যাচ্ছে ভক্ষকরাই রক্ষকের স্থানে চলে আসছেন। আজকে পুরো সমাজে পুঁজিবাদের যে ব্যাধিটা ছড়িয়ে পড়েছে, সেই ব্যাধিই কিন্তু সব কিছুকে ভোগের পণ্যে পরিণত করছে। এই রাস্তায় মেয়েদের উত্ত্যক্ত করছে দুর্বৃত্তরা, এরা বেকার। এখানে বেকারত্বের সমস্যাটা একটা ভয়ঙ্কর সমস্যা। বেকারত্বের দুটো মাত্রা আছে। একটা মাত্রা হচ্ছে, জীবিকার সংস্থান নেই বলে বেকার। আরেকটা হচ্ছে জীবিকার সংস্থান থাকলেও জীবনের কোনো কাজ নেই বলে বেকার। জীবনের মানে যে সৃষ্টিশীলতা, কর্মমুখরতা, উদ্ভাবনসহ এমন কাজের সঙ্গে যুক্ত হওয়া সেই কাজগুলো সে পাচ্ছে না। রাজনৈতিকভাবে পাচ্ছে না, সাংস্কৃতিকভাবেও পাচ্ছে না। কাজেই যারা জীবিকার জন্য কাজ পেয়েছে কিন্তু জীবনের জন্য কাজ পায়নি, তারা কাজ পেয়েও বেকার। যেমন এই দুর্বৃত্ত শিক্ষকটি। তার সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। এই চ্যালেঞ্জটা কিন্তু আমাদের জীবনে ছিল, রাষ্ট্র যখন বিদেশীদের হাতে ছিল, আমরা লড়েছি। যখন রাষ্ট্র আমাদের নিজেদের হয়ে গেল, তখন আমাদের সমাজকে পরিবর্তন করা দরকার ছিল, আর মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নটাই ছিল এখানে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করল, তখন সেটাকেই মনে করলাম মুক্তি। কিন্তু আসল মুক্তি তো হয়নি। যেটা প্রয়োজন ছিল সেদিন, ওই মুহূর্ত থেকে মুক্তির যে সংগ্রাম, সমাজকে পরিবর্তিত করার যে সংগ্রাম, সমাজে বিপ্লব ঘটানোর যে সংগ্রাম- সেই সংগ্রামটাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেটাই কিন্তু ছিল আমাদের সমষ্টিগত চাওয়া।
বুধবার : ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনটির অনেক সদস্যের ব্যাপারে যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে ছাত্র রাজনীতির কার্যক্রম সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কি?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : এখানে ছাত্র রাজনীতির কোনো দায়িত্ব নয়, দায়িত্বটা হচ্ছে এই ছাত্র রাজনীতির নেতাকর্মীদের যারা পৃষ্ঠপোষকতা করে। এসব হতো না যদি নিয়মিত ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন হতো। ছাত্র রাজনীতি যেটাকে বলা হয়, আমি সেটাকে ছাত্র আন্দোলন বলি। ছাত্র আন্দোলন যত রকম অন্যায় ঘটে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। আদর্শবান ছাত্ররা তাই করেছে। এখন ছাত্র রাজনীতির নামে যেটা চলছে এখানে সেই আদর্শটা নেই।
বুধবার : সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষা সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ, রদবদল ঘটে থাকে। এটাকে আপনি কতটা বিপজ্জনক মনে করেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : এটা খুবই বিপজ্জনক। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তি করা হয় কিন্তু তার সামাজিক, সংস্কৃতিক নিরাপত্তা দেবে বলেই। কিন্তু যখন এই ধরনের দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ ও রদবদল ঘটে থাকে তখন এই নিরাপত্তা দেওয়া যায় না। কারণ দলীয়করণের ফলে মেধার অবমূল্যায়ন করা হয়।
বুধবার : কতিপয় শিক্ষক গণতান্ত্রিক ভাবাদর্শের প্রতি অনুরক্ত হওয়ার বদলে, নির্বিচারে রাজনৈতিক দলসমূহের ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন এবং দলাদলিতে যুক্ত হচ্ছেন। এটা কতটা যৌক্তিক?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : অল্প কিছু শিক্ষক এই কাজগুলো করেন। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থের কারণেই এই কজগুলো করছে। এটা শুরু হয় এরশাদের পতনের পর থেকে। দেখা গেল দুই রাজনৈতিক দলের সঙ্গে শিক্ষকদের একটা অংশ যোগাযোগ করছে। এই যোগাযোগ করে তারা সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছে। এটা অল্প কিছু শিক্ষক করে। এজন্য সব শিক্ষককে দায়ী করা মোটেও উচিত নয়।
বুধবার : দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে আপনি কতটা স্বস্তিবোধ করছেন?
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী : বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে আমি মোটেই স্বস্তিবোধ করছি না। আমি শুরুতেই বলেছি আমার রক্ত হিম হয়ে যায়। আমাদের সমাজে মেয়েদের স্থান এমনিতেই দুর্বল। এটা একটা পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থা। এখানে শিক্ষা নারীকে একটা ক্ষমতা দিচ্ছে। সেই ক্ষমতাদানের ক্ষেত্রটাতে যদি মেয়েরা এভাবে আক্রান্ত হয় এর চেয়ে বড় দুঃখ আর হতাশার ব্যাপার আর থাকে না। আমি মনে করি এই সমাজে যদি পরিবর্তন আনতে হয় তাহলে মেয়েদের এগিয়ে আসতে হবে। মেয়েরা এগিয়ে এসেছেও। কিন্তু এই ব্যবস্থা তাদের এগিয়ে আসতে দিচ্ছে না। এখানে আমি একটা উদাহারণ দিয়ে বলব, আমাদের সমাজ কেমন করে নারীদের দেখে। এই যে মুক্তিযুদ্ধে নারীরা নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তাদের উপাধি দেওয়া হয়েছে বীরাঙ্গনা। এটা কোনো গৌরবের ব্যাপার নয়, সমাজে যদি একজন নারী বীরাঙ্গনা হিসেবে পরিচয় দেয় তাহলে তাকে কেউ সম্মান দেখাবে না। এই সমাজ এমন বিকৃত যে, যারা এই উপাধি দিয়েছিল তারা মনে করেছে এটা দিয়ে ওই নারীকে সম্মানিত করা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতার্থে তাকে অপমানিত করা হয়েছে। এটা সমাজ বিকৃতিরই একটা দৃষ্টান্ত।

শনিবার, ২৫ জুন, ২০১১

শিল্পের কোনো প্রগতি নেই, আছে কেবল পরিবর্তন - আরনেস্টো সাবাতো

এ বছর আর্জেন্টিনাইন লেখক আরনেস্টো সাবাতোর জন্মের শতবার্ষিকী। জন্ম ২৪ জুন ১৯১১।যদিও মৃত্যুও এবছরই। যা হোক তার জন্মশতবার্ষিকী স্মরণে এ আয়োজন।
সাক্ষাত্কারটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন মিলটন মোললা
প্রশ্ন : আপনি একজন পেশাদার বিজ্ঞানী। ‘মেন অ্যান্ড গিয়ারস’ শিরোনামে একগুচ্ছ প্রবন্ধ আছে আপনার। ১৯৫১ সালে লেখা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বৈরী আঘাতে মানুষের বিমানবীকরণের অশুভ পরিণতি নিয়ে কথা বলেছেন আপনি। একজন বিজ্ঞানী হওয়া সত্ত্বেও এভাবে ভাবতে পারলেন কীভাবে?
আরনেস্টো সাবাতো : পদার্থবিদ্যা এবং গণিত নিয়ে পড়াশোনা করেছি আমি। এদের বলা চলে জাগতিক বিশৃঙ্খলা থেকে আমার বিমূর্ত আশ্রয়। কিন্তু শিগগিরই আমি উপলব্ধি করলাম, বিশুদ্ধ চিন্তার ওপর ‘অন্ধবিশ্বাসী’ কতিপয় বিজ্ঞানী দুর্ভাগ্যবশত উপেক্ষা করছেন অবচেতন কিংবা পুরাণের মতো জরুরি বিষয়। অথচ এসবের মধ্যেই নিহিত সব সৃষ্টির আদি রহস্য। এটাই মানুষের ‘অবগুণ্ঠিত’ প্রকৃতি। আমার শুদ্ধতম বৈজ্ঞানিক চিন্তার ক্ষেত্রে ‘মিসিং লিংক’গুলো জোড়া দিতে আমাকে সাহায্য করল জার্মান রোমান্টিসিজম, অস্তিত্ববাদ এবং পরাবাস্তববাদ। মনে হল, সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠতে চাইলে প্রত্যেক ড. জেকিলের প্রয়োজন একজন মি. হাইড। এরপরই লগারিদম আর জ্যামিতির জটিল নকশা থেকে মুখ তুলে মানুষের মুখের পানে তাকালাম। আর কখনও ফিরিয়ে নিইনি সে মুখ।
প্রশ্ন : এ সময়ের অনেক লেখক অবশ্য বিজ্ঞান এবং সৃজনশীলতাকে এক টেবিলে আনার চেষ্টা...
সাবাতো : হতে পারে। কিন্তু আমি মনে করি, আমাদের যুগটা চিহ্নিত হয়ে থাকবে বিজ্ঞান এবং মানবিকতার মধ্যে বিরোধিতার যুগ হিসেবে। ঊনবিংশ শতকে বিজ্ঞান এবং প্রগতির দুর্নিবার অভিযানের পরিণতিতে মানুষ নিজেকে একপর্যায়ে আবিষ্কার করে তারই উদ্ভাবিত বিশাল যন্ত্রের নগণ্য এক উপকরণ হিসেবে। আজকের দুনিয়ায়, ব্যক্তি হারিয়ে গেছে জনতার ভিড়ে।
প্রশ্ন : কিন্তু হেগেলের যুক্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ওই শতকেই আবির্ভূত হয়েছিলেন কিয়ের্কেগার্দ। তার সম্পর্কে বিস্তর কাজও করেছেন আপনি।
সাবাতো : কিয়ের্কেগার্দ পৃথিবীর প্রথম চিন্তাবিদ যিনি প্রশ্ন করেছেন, বিজ্ঞান জীবনের চাইতে জরুরি কি না এবং তার উত্তরও নিজেই দিয়েছেন-প্রথমে জীবন। তার চিন্তার পথ ধরে বিশ শতকের অস্তিত্ববাদী কার্ল জেসপার এবং মার্টিন হাইডেগার বলেন, মানুষ ‘বিচ্ছিন্ন’ সত্তা মাত্র নয়, এই মহাসৃষ্টির কেন্দ্র। মৃত্যু যার নিয়তি। যার থেকে উত্সারিত সব বেদনা আর আধ্যাত্মিকতা।
প্রশ্ন : কিন্তু এই তো একমাত্র নয়...
সাবাতো : নিশ্চয়ই নয়। দস্তয়ভস্কির ‘নোটস ফ্রম দি আন্ডারগ্রাউন্ড’ উপন্যাসে তিনি তীব্রভাবে বিলুপ্তি কামনা করেছেন আধুনিকতা আর প্রগতির পূজার।
প্রশ্ন : বর্তমানে আমরা সাহিত্যের মধ্যে...
সাবাতো : হ্যাঁ, এর কারণ দর্শন কিংবা প্রবন্ধের চেয়ে একটি উপন্যাস অনেক গভীরভাবে ব্যাখ্যা করতে সক্ষম মানুষের অনিশ্চয়তা, নিয়তি আর জীবনের অর্থ। ধারণা নয়, চিন্তার জাদুকরী বৈশিষ্ট্য কিংবা পুরাণ আর প্রতীকের মাধ্যমে এই সবকিছু ব্যাখ্যা করে উপন্যাস।
প্রশ্ন : এভাবে কি বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা করে সাহিত্য?
সাবাতো : সৌভাগ্যক্রমে শিল্প এবং সাহিত্য কখনও কল্পনা থেকে যুক্তি, বুদ্ধি থেকে আবেগ এবং বাস্তবতা থেকে স্বপ্নকে পৃথক করে দেখে না। স্বপ্ন, পুরাণ এবং শিল্পকলার অভিন্ন উত্স থাকে মানুষের অবচেতনে। এমন এক পৃথিবী উন্মোচন করে তারা যা অন্য কোনোভাবে সম্ভব নয়। শিল্পীকে তার শিল্পকর্ম ব্যাখ্যা করতে বলাটা অর্থহীন। এ কী কল্পনা করা সম্ভব যে, বেটোভেন তার সিম্ফনিগুলো বিশ্লেষণ করছেন, কিংবা কাফকা উপলব্ধির চেষ্টা করছেন ‘দ্য ট্রায়াল’ গল্পে তিনি মূলত কী বলতে চেয়েছেন।
প্রশ্ন : বর্তমান যুগটিকে আপনি মনে করেন আধুনিক চিন্তার সর্বশেষ ধাপ।
সাবাতো : চিন্তার মূল ধারার সঙ্গে সাহিত্যকে গুলিয়ে ফেলা অনুচিত হবে। মুক্তচিন্তার বিস্তৃত পৃথিবীতে কখনও সামনে, কখনও পিছিয়ে আসতে হয়েছে। অবশ্য এটা স্পষ্ট, এ মুহূর্তে আমরা এক যুগপতনের সাক্ষী। সভ্যতার এমন এক সঙ্ঘাতকাল অতিক্রম করছি আমরা, যেখানে প্রেম এবং জ্ঞান, কিংবা আনন্দ আর বেদনার মাঝে বিরাজ করছে চিরকালীন বিরোধ।
প্রশ্ন : এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব?
সাবাতো : এ থেকে মুক্তির একমাত্র পথ দুর্ভোগের মধ্যে বসবাসকারী যান্ত্রিক নিষ্পেশনের শিকার মানুষকে যন্ত্র থেকে বিযুক্ত করা। কিন্তু মনে রাখতে হবে, একটা যুগ ওই সময়ের সব মানুষের জন্য একই সময়ে মৃত্যুবরণ করে না। ঊনবিংশ শতকে প্রগতির বিজয়ঝাণ্ডা যখন পতপত করছে দিকে দিকে, ততদিনে কিন্তু সাময়িকতা হারিয়ে বসে আছেন দস্তয়ভস্কি, কিয়ের্কেগার্দ কিংবা নীেস। নতুন সময়ের সঙ্কট চিত্রিত করতে ততদিনে হাজির হয়েছেন কাফকা, সার্ত্রে এবং কাম্যুর মতো একঝাঁক নতুন লেখক।
প্রশ্ন : এ কারণে কি আপনি শিল্পে ‘প্রগতি’র ধারণাকে খারিজ করে দেন?
সাবাতো : স্বপ্ন যতটুকু প্রগতি নিশ্চিত করে তার চেয়ে বেশি কিছু করতে পারে না শিল্প। বাইবেলের নবীর চেয়ে আমাদের দুঃস্বপ্নগুলো কি কম ভয়ঙ্কর? আমরা এ কথা বলতে পারি, আইনস্টাইনের গণিত আর্কিমিডিসের গণিতের চেয়ে উচ্চতর, কিন্তু আমরা কি একবারও বলতে পারি, হোমারের অডেসির চেয়ে মহত্ উপন্যাস জয়েসের ইউলিসিস? প্রুস্ত-এর এক চরিত্র একবার দাবি করে বসল, বেটোভেনের চেয়ে দেবুসি উত্তম সঙ্গীতজ্ঞ শুধু এ কারণে যে তিনি পরবর্তী প্রজন্মের প্রতিনিধি। প্রত্যেক শিল্পী চায় ‘পরম’ র্স্পশ করতে। তা সে দ্বিতীয় রামেসেস যুগের কোনো ভাস্কর হোক, কিংবা ধ্রুপদী যুগের কোনো গ্রিক শিল্পী হোক। এ কারণে দেখা যায়, শিল্পে কোনো প্রগতি নেই, আছে কেবল পরিবর্তন। অন্তত একটা বিষয় নিশ্চিত, শুধু পরবর্তীতে জন্মানোর কারণে কোনো শিল্পী অন্য কারও তুলনায় মহত্ হয়ে ওঠে না।
প্রশ্ন : অর্থাত্ আপনি সার্বজনীন নন্দনতত্ত্ব বলে কিছু বিশ্বাস করেন না?
সাবাতো : ইতিহাসের আপেক্ষিকতা প্রতিফলিত হয় নন্দনতত্ত্বে। প্রত্যেক যুগের একটি প্রধান মূল্যবোধ থাকে-ধর্মীয়, অর্থনৈতিক কিংবা আধ্যাত্মিক। ইতিহাস আমাদের দেখিয়েছে সুন্দর আর সত্য এক যুগ থেকে অন্য যুগে বদলে বদলে যায়। লেখক, শিল্পী কিংবা সংগীতজ্ঞের খ্যাতি স্রেফ পেন্ডুলামের দোলকের মতো।
প্রশ্ন : সে ক্ষেত্রে, এক সংস্কৃতি কখনও অন্য সংস্কৃতির ওপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে না।
সাবাতো : সঙ্কীর্ণ দখলদারিত্বের মানসিকতা অনেক পেছেনে ফেলে এসেছি আমরা। লেভি ব্রুহল বলেন, জাদু বাস্তবতা থেকে যুক্তিবাদী চিন্তনের মধ্যে তিনি কোনো পার্থক্য খুঁজে পান না। মানুষের মধ্যেই সহাবস্থান করে এ দুটি বিষয়। প্রতিটি সংস্কৃতির প্রাপ্য মর্যাদা রয়েছে।
প্রশ্ন : আজকাল স্কুলে কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষাদান পদ্ধতি নিয়ে আপনার মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে? এখানে কী করার আছে?
সাবাতো : যখন আমি ছোট ছিলাম, আমাকে গাদাগাদা তথ্য মুখস্থ করতে হত। অবধারিত যা আমি ভুলে যেতাম একসময়। আমি এখনও কোনোমতে মনে করতে পারি শুধু কেপ অব গুড হোপ এবং কেপ হর্নের কথা। তাও সম্ভবত এ কারণে যে, নাম দুটি প্রায়ই সংবাদপত্রে হাজির হয়। কে যেন বলেছিল একবার, সবকিছু হারিয়ে যাওয়ার পরও তোমার যা অবশিষ্ট আছে তাই তোমার সংস্কৃতি। শিক্ষার অর্থ অংশগ্রহণ, আবিষ্কার এবং উদ্ভাবন। সামনে এগিয়ে যেতে চাইলে মানুষকে নিজের মতামত তৈরি করতে হবে। কখনও এর অর্থ হতে পারে ভুল করা এবং পুনরায় গোড়া থেকে শুরু করা। নতুন পথ আবিষ্কার করতে হবে। নতুন পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে। গ্রন্থ এক চমত্কার মাধ্যম। তবে দেখতে হবে তা যেন আমাদের নিজস্বতাকে ব্যাহত না করে।
প্রশ্ন : শিক্ষকের ভূমিকা কীভাবে দেখেন আপনি?
সাবাতো : বুত্পত্তিগত অর্থে, শিক্ষা অর্থ উন্নয়ন। যা আছে ভ্রুণ অবস্থায় তাকে বিকশিত করা। সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করা। শিক্ষার্থীকে প্রশ্ন করা শিখতে হবে। নিজের অজ্ঞতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে তার। প্রশ্ন উত্থাপনের পাশাপাশি নিজের চিন্তা প্রক্রিয়াকে সক্রিয় রাখতে হবে। দ্বিমত হয়, হোক। তাদের জন্য ভুল করার কাজটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একমাত্র তখনই তারা উপলব্ধি করবে, আমাদের জ্ঞানের দ্বারা সীমিত পৃথিবীর বাইরে রয়ে গেছে অব্যাখ্যাত অনেক রহস্য। বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড নিজেই এক শেষহীন রহস্যের আধার। কান্ট যেমন বলেছেন, মানুষকে দর্শন শিক্ষা দিতে হবে না। তাকে দার্শনিক প্রক্রিয়ায় চিন্তা করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে।
প্রশ্ন : নির্দিষ্ট কোনো উদাহরণ...
সাবাতো : অনেক দিন আগে প্যাটাগোনিয়াতে জিপে করে এক বনের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন এক বন কর্মকর্তা। আমাকে তিনি বনের ধ্বংস প্রক্রিয়া সম্পর্কে বলছিলেন। একসময় জানালেন, সাইপ্রেস গাছের কথা। বনের প্রান্তসীমায় বেড়ে ওঠা এসব গাছ নিজেকে পোড়াতে দীর্ঘ সময় নিয়ে অন্য গাছ রক্ষা করে। এমন চমকপ্রদ একটি তথ্য জেনে মুগ্ধ হলাম আমি। ভূগোল মুখস্থ করি আমরা। অথচ জাতিসত্তা কিংবা ভূ-প্রকৃতি সম্পর্কে কী চমত্কার ছবি আঁকা আছে জুল ভার্নের ‘অ্যারাউন্ড দি ওয়ার্ল্ড ইন এইট্টি ডেজ’ গল্পে। বিশ্বকে দেখতে হবে বিস্ময়ের চোখে। বিশ্বের সবকিছুই বিস্ময়কর। নিত্যপরিচিতির ভিড়ে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আমাদের বিস্মিত হওয়ার ক্ষমতা।
প্রশ্ন : আপনি বলেন, বর্তমান থেকে শুরু করে অতীতের উদ্দেশে যাত্রার প্রক্রিয়ায় শিক্ষা দিতে হবে...
সাবাতো : আমার মনে হয়, তরুণ শিক্ষার্থীদের পড়ার প্রতি আকর্ষণ বাড়ানোর শ্রেষ্ঠ পদ্ধতি সমসাময়িক লেখকের বই পড়ার সুযোগ করে দেওয়া। কারণ তারাই প্রকৃত ধারণ করেন এসব শিশুর আশা এবং আশঙ্কা। পরবর্তীতে তারা জানার চেষ্টা করবে ভালোবাসা কিংবা মৃত্যু, আশা আর হতাশা কিংবা বীরত্ব আর একাকিত্ব নিয়ে কী লেখে গেছেন হোমার কিংবা সারভান্তেস। আরেকটি ভুল হচ্ছে, সবকিছু শেখানোর প্রয়াস। অল্প কিছু ঘটনা, অল্প কিছু বক্তব্যই যথেষ্ট। তবে তার মধ্যে থাকতে হবে তীব্র আবেগ। পড়া তখনই আনন্দময় যখন তা পাঠকের হূদয় বীণায় টঙ্কার তুলতে সক্ষম হয়। তোলে। পড়াটা যেন এমন না হয়, যেন সারি সারি কবরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি, প্রাণ নেই একবিন্দু! এমন ভাবার কারণ নেই যে, গুটেনবার্গের আগে পৃথিবীতে সংস্কৃতি বলে কোনো ব্যাপার ছিল না।
প্রশ্ন : দীর্ঘদিন ধরেই আপনি বলে আসছেন পারমাণবিক অস্ত্রের সর্বনাশা বিপদের কথা। হিসাবের খাতায় আপনি কি কোনো অর্জন দেখতে পান না?
সাবাতো : প্রথমত, পারমাণবিক শক্তির বিস্তার আজ এক অবধারিত বাস্তব। অনেক দেশই আজ পারমাণবিক ক্ষুদে শক্তিধর। সব ধরনের প্রতিবাদী জনতার মধ্যে আমি এর প্রভাব দেখতে পাই। আজকের পৃথিবীতে মানুষের সমস্যা প্রধানত দার্শনিক, সামরিক নয়। আমি এমন একসময়ের সন্তান, ধ্বংসের মধ্যেই যার পরিণতি। শিল্প, সংলাপ, স্বাধীনতা আর ব্যক্তিমানুষের মর্যাদায় বিশ্বাস করি আমি। এসব কথায় কে গুরুত্ব দেয়। অপমানের স্থান দখল করেছে সংলাপ, রাজনৈতিক বন্দিত্বের স্থানে এসেছে স্বাধীনতা। রাষ্ট্র যদি পুলিশি হয়, সেটা ডানপন্থী নাকি বামপন্থী তাতে কী আসে যায়? ভালো নির্যাতন আর মন্দ নির্যাতন বলে কোনো বিষয় থাকতে পারে না। আমাকে প্রতিক্রিয়াশীল বলা যেতেই পারে, কেননা আমি এখনও বিশ্বাস করি মধ্যযুগীয় গণতন্ত্রে, যা অন্তত মানুষের নিশ্চিত করে মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা। যার মধ্যে নির্মিত হয় সুন্দর আগামীর পথ।

সোমবার, ১৬ মে, ২০১১

আমার বিশ্বাসের জায়গা থেকে আমি ছবি নির্মাণ করি - চিত্রনির্মাতা আববাস কিয়ারসতামি

চিত্রনির্মাতা আববাস কিয়ারসতামির সাক্ষাৎকার

আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত চিত্রনির্মাতা আববাস কিয়ারসতামির জন্ম ইরানের তেহরানে ১৯৪০ সালে। ইরানের বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ফাইন আর্টসে গ্র্যাজুয়েশন করার পর গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে তার কর্মজীবন শুরু করেন। তিরিশ বছয় বয়সে সেন্টার ফর ইন্টেলেকচুয়াল ডেভেলপমেন্ট অব চিল্ড্রেন অ্যান্ড অ্যাডাল্টসের ফিল্ম সেকশানে যোগদান করেন এবং তখন থেকেই চিত্রনির্মাতা হিসেবে তার আত্মপ্রকাশ ঘটতে থাকে। সেখানে বেশ কিছু শিশুতোষ এবং ডকুমেন্টারি নির্মাণের পর ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেন পূর্ণ দৈর্ঘ্য ছবি ‘দ্য এক্সপেরিয়েন্স’। এরপর একে একে দ্য ট্র্যাভেলার, দ্য ওয়েডিং স্যুট, দ্য রিপোর্ট, ওয়ের ইজ দ্য ফ্রেন্স হোম, হোমওয়ার্ক, ক্লোজ আপ, অ্যান্ড লাইফ গোজ অন, থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ এবং তার অন্যতম অনবদ্য ছবি ‘টেস্ট অব এ চেরি’সহ আরো অনেক ছবি নির্মাণ করেন। ১৯৮৩ সালে কান ফিল্ম ফেস্টিভালের জুরি মেম্বার হিসেবে তাকে নির্বাচিত করা হয়। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভেলে ১৯৯৫ সালে জুরি হিসেবে ছিলেন। লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্টের জন্য তাকে ২০০৫-এ ইয়েরেভেন ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভেলে অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। চিত্র নির্মাতা হিসেবে অবদানের জন্য ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট থেকে ফেলো হিসেবে সম্মাননা প্রদান করে। সম্প্রতি ২০১০-এর ৯ মার্চ তেহরানের একটি পত্রিকায় সরকারের কাছে চিঠির মাধ্যমে ইরানের স্বতন্ত্র ধারার দু’জন বিশিষ্ট চিত্রপরিচালক জাফার পানাহি এবং মোহাম্মদ রোজুউলফের কারাবন্দি মুক্তির জন্যে আবেদন করেন। সে আবেদনের সাড়ায় পরবর্তিতে তারা মুক্তিলাভ করেন। সেই কিংবদন্তি পরিচালকের একটি ভিডিও সাক্ষাৎকার সংক্ষেপিত আকারে উপস্থাপন করা হলো। বিষয়ভিত্তিতে তিনি সাক্ষাৎকারে তার নিজের কথা বলে গেছেন।

সেন্সরশিপ প্রসঙ্গে : আমার ছবির ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি বিপ্লবের আগে সেন্সরশিপ আমার ছবিতে খুব একটা প্রভাব ফেলত না। কিন্তু এটা সবার ক্ষেত্রে এরকম ঘটতো তা বলা যায় না। আসলে ইরানে ছবির সেন্সরশিপ মূলত ধর্মীয় কারণে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। বিশেষ করে ছবিতে নারীর হিজাব পরিধানের ক্ষেত্রে ইরানে বেশ কড়াকড়ি নিয়ম বা আইন উল্লিখিত আছে। নারীরা হিজাব ছাড়া ছবিতে অভিনয় করতে পারবে না, এমনকি ঢিলেঢালা হিজাবও পরিত্যাজ্য। তাছাড়া নারী-পুরুষের স্পর্শের ব্যাপারেও বিধিনিষেধ আছে। আমাদের নিজেদের অর্থাৎ চিত্রপরিচালকদের মাঝে সেন্সরশিপ নেই তা বলব না, কিন্তু এসব বিধিনিষেধ অবলম্বন করেই আমরা আমাদের ছবি নির্মাণ করি। আর তাই আমি শুধু সেসব ছবিই নির্মাণ করি যেগুলো নির্মাণ করতে চেয়েছি। আমি কখনো স্বামী-স্ত্রী একত্রে একটি অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসরত কোনো গল্প নির্বাচন করি না। কারণ আপনি যখন একটি ছবি নির্মাণ করেন তখন আপনাকে সেই ছবির গল্পের প্রতি বিশ্বাস থাকতে হবে। ছবিতে আমরা সাধারণত এক সারি-বাঁধা মিথ্যের মধ্য দিয়ে সত্যে উপনিত হই। যেমন ছবিতে যখন একটি পরিবারের কাহিনী দেখানো হয় তখন বাস্তব কোনো পরিবার উপস্থাপিত হয় না। ভিন্ন ভিন্ন নারী, পুরুষ এবং শিশু অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সমন্বয়ে পরিবার গঠন করা হয়। বাস্তব পরিবারে স্ত্রী তার স্বামীর সামনে হিজাব পরিহিত অবস্থায় থাকে না। কিন্তু ছবির প্রয়োজনে আমাকে তা দেখাতে হয়। আমার ছোটবেলায় আমি কখনো আমার মাকে বাবার সামনে হিজাব পরিহিত অবস্থায় দেখিনি। কাজেই আমি যা দেখিনি তা ছবিতে উপস্থাপন করতে চাই না বলেই আমার ছবিতে সাধারণত এই ধরনের কোনো গল্প রাখি না। আর এই কারণেই হয়তো অবচেতনভাবেই আমি আমার ছবির গল্পের জন্য গ্রাম বেছে নেই।

আমি যখন ইরানের বাইরে যাই বিশেষত পাশ্চাত্যে, তখন আমাকে সেন্সরশিপ সংক্রান্ত নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়, যা আমাকে খুবই বিব্রত করে। পাশ্চাত্যের লোকেরা মনে করে, আমরা যারা তৃতীয় বিশ্বের নির্মাতা তারা কড়া বিধি-নিষেধের সেন্সরশিপের ঘেরাটোপের মধ্য থেকে ছবি নির্মাণ করি। এটা নিয়ে যখন ভাবি তখন আমি অনুধাবন করি, শুধু ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে নয়, আমাদের দেশে সাধারণ নাগরিক হিসেবেও সেন্সরশিপ আরোপিত হয়ে আছে। সেন্সরশিপের যাত্রা শুরু হয় পারিবারিক পরিমন্ডল থেকে। পরিবারিক বিধিনিষেধের কারণে আমার মন যা চায় তা বলতে বা করতে পারি না। কারণ আমার অভিভাবক কোনটা ঠিক আর কোনটা ঠিক না- তা আগে থেকেই নির্ধারণ করে দেন। বিদ্যালয় অধিকতর সেন্সরশিপের একটি জায়গা যেখানে কঠোর শৃঙ্খলা বজায় রেখে চলতে হয় এবং যা আমাদের কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত প্রসারিত হতে থাকে। কাজেই আমার মনে হয় না সেন্সরশিপ আমাদের খুব একটা বিব্রত করে বা অসুবিধায় ফেলে, কারণ আমরা আমাদের মতো করে তা সামাল দিতে পারি। বিশেষত নির্মাতা হিসেবে আমরা যত বেশি বিধিনিষেধের মধ্যে পরিবেষ্টিত হই তত বেশি নতুন নতুন পন্থা এবং সমাধানের পথ নিজেরা নিজেদের মতো করে খুঁজে নেই। আমার বাবা বলতেন, তোমার মাথা যদি ভাঙে তবে তা যেন তোমার টুপির ভেতরেই ভাঙে। কাজেই সেন্সরশিপ নিয়ে দেশের বাইরে আমি যতই কথা বলি না কেন তা কখনো কোনো সমাধান এনে দেবে না। আর তাই এই বিষয় নিয়ে দেশের বাইরে আমি কখনো কথা বলি না বা বলতে চাই না, বিশেষত সাংবাদিকদের সঙ্গে। বরং উল্টো তাদের প্রশ্ন করি- ‘তোমাদের নিজেদেরও কী কোনো সেন্সরশিপ নেই?’ তাছাড়া আমাদের সরকার সেন্সরশিপ আরোপের সঙ্গে ছবি নির্মাণের জন্য আর্থিক সহায়তাও প্রদান করে থাকে। ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনে সদর্থক দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে সেন্সরশিপের ব্যাপারে আমার খুব বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। এর অর্থ এই নয় যে, সেন্সরশিপের পৃষ্ঠপোষকতা করি, আমি তাদের বলি তোমরা তোমাদের কাজ কর, আমরা আমাদেরটা করি। কারণ আমি জানি শেষ পর্যন্ত আমাদের কাজগুলোই (সিনেমা) টিকে থাকবে।

পাশ্চাত্যে সমাদর : দেশের বাইরে বিশেষত পাশ্চাত্যে যখন আমাদের ছবি প্রদর্শিত হয় তখন সে সব বেশ সমাদৃত হয়- যা আমাদের ছবি নির্মাণের ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা যোগায় এবং যখনই আপনার ভেতর অনুপ্রেরণা জন্মাবে আপনি তখন আরও বেশি সাহসী হয়ে উঠবেন, নতুন নতুন ধারণায় উজ্জীবিত হবেন। দেশের ভেতরে আমাদের ছবি খুব বেশি সমাদৃত না হলেও বিদেশে আমাদের ছবি বেশ সমাদৃত। তবে সেই সঙ্গে এটাও ঠিক পাশ্চাত্যের এই পৃষ্ঠপোষকতা আমার ছবির স্টাইল এবং টেকনিকের ক্ষেত্রে খুব বেশি পরিবর্তন আনতে পারেনি। অর্থাৎ যেভাবে পাশ্চাত্য সমালোচকরা আশা করেন সেভাবে ছবি নির্মাণ করা আমার পক্ষে সম্ভব হয় না। কারণ, আমি যখন ছবি নির্মাণ করি তখন গল্পের বিষয়বস্ত্তর ওপর প্রথমে গুরুত্বারোপ করি। আমি মনে করি, ছবির বিষয় ছবির শৈলীকে নির্মাণ করে। শৈলী বিষয়কে নির্মাণ করে না। আরো বিশ্বাস করি, ছবি নির্মাণের এটাই সঠিক পদ্ধতি। পাশ্চাত্য সমালোচকদের বা ফেস্টিভেলের দর্শকদের ইচ্ছানুযায়ী ছবি নির্মাণ করা তাই আমার পক্ষে সম্ভব নয়। প্রত্যেক ছবি তার নিজস্ব প্রয়োজনানুযায়ী নির্মিত হয়।

পরিচালকের শৈলী : আমার ছবির ভালো-মন্দ দিক নিয়ে কথা বলা একটু অসুবিধাজনক, কারণ সেটা আপনারাই ভালো বলতে পারবেন। তবে আমার যা ভালো লাগে না সে বিষয়ে আমার পক্ষে বলাটা তুলনামূলকভাবে সুবিধাজনক। আমার যা ভালো লাগে না তা আপনারা আমার ছবিতে দেখতে পাবেন না। ছবিতে গল্প বলা আমার পছন্দ নয়। কারণ আমি দর্শকদের কোনো ধরনের আবেগাপ্লুত করতে বা উপদেশ দিতে পছন্দ করি না। দর্শককে খাটো করা বা অপরাধবোধে যুক্ত করা আমার ভালো লাগে না। আমি মনে করি সেই ছবি ভালো যার দীর্ঘস্থায়িত্ব আছে। হল থেকে বের হয়ে আসার পর দর্শকরা সেই ছবির বিনির্মাণ করতে থাকবে। এমন অনেক ছবি আছে যা আপাতদৃষ্টিতে ক্লান্তিকর মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে পরিচ্ছন্ন ছবি। অপরদিকে এমন অনেক ছবি আছে যেসব ছবি দর্শককে তীব্রভাবে ধরে রাখে এবং সবকিছু ভুলিয়ে রাখে। কিন্তু ছবি দেখা শেষ হলে পরে দর্শক বুঝতে পারে সে ভীষণভাবে প্রতারিত হয়েছে। এসব ছবি দর্শককে পণবন্দি করে রাখে। এ ধরনের ছবি আমার একদম পছন্দ নয়। কিছু ছবি মনে এমনভাবে দাগ কাটে যে, সেই ছবির অর্থোদ্ধারের লক্ষ্যে মাঝরাতে আমার ঘুম ভেঙে যায়। এমনকি সপ্তাহের পর সপ্তাহ সেই ছবি নিয়ে ভাবতে থাকি। এই ধরনের ছবি আমার অত্যন্ত পছন্দীয়।

ছবির চরিত্রাবলী : অনেকে বলে থাকেন আমার ছবির চরিত্রগুলো অস্বাভাবিক। প্রচলিত প্রথার বাইরের চরিত্র। যেমন ‘দ্য ট্র্যাভেলার’-এর ছোট্ট শিশুটি, ‘দ্য রিপোর্ট’ ছবির মি. ফিরোজ কুহি, ‘ক্লোজআপ’-এর হোসেইন সাবজাইন বা ‘থ্রু দ্য অলিভ ট্রিজ’-এর হোসেন চরিত্র। যেহেতু সমাজের সব চরিত্রকে একত্রে ক্যামেরাবন্দি করা সম্ভব নয় তাই আমাকে সমাজের বিশেষ ধরনের মানুষটিকে খুঁজে নিতে হয় বা কোনো ব্যতিক্রম পরিবেশের খুব সাধারণ মানুষ। তাদের সেই বিশেষত্ত্বটা কি? বিশেষত্ত্বটা হচ্ছে ছবির ওই বিশেষ চরিত্রের মানুষটি ঠিক আমাদের মতোই এবং আমি মনে করি এই কারণেই একজন চিত্রপরিচালক সেসব খুঁজে ছবি নির্মাণ করেন।


বাস্তব এবং বিভ্রম : বাস্তব এবং বিভ্রমের মাঝে পার্থক্যের বিষয়টি এতো জটিল এবং বিশাল যে আমি ভেবে পাই না কোত্থেকে শুরু করব। আমার কর্মক্ষেত্র এবং আমার জীবনের কতটুকু অংশ বাস্তব এবং কতটুকু অংশ কাল্পনিক, এই অভিজ্ঞতা কীভাবে আমি অর্জন করেছি তা বলতে পারব না। শুধু চিত্রপরিচালক হিসেবে নয় ব্যক্তিগত জীবনেও এই খেলাটি অর্থাৎ একবার কল্পনা থেকে বাস্তব, আবার বাস্তব থেকে কল্পনা, আবার বাস্তবে ইতস্ততভাবে ঘোরাঘুরি করে। এই বিষয়টি শুধু চিত্রপরিচালক বা বুদ্ধিজীবীদের ক্ষেত্রেই নয়, সাধারণ মানুষের মাঝেও একইভাবে অনুভূত হয়। মানব চরিত্রের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ‘স্বপ্ন দেখার যোগ্যতা অর্জন’। যদিও প্রত্যেকেই আমরা কমবেশি স্বপ্ন দেখি, কিন্তু খুব কম মানুষই স্বপ্নের কথা বলতে পারি অর্থাৎ বাস্তবায়ন করতে পারি। মানব জীবনের সব থেকে স্বতন্ত্র এবং বিশেষ অবদান হচ্ছে কল্পনা করার ক্ষমতা অর্জন করা। আমরা আমাদের অন্যান্য অনুভূতি যেমন- দেখা, শোনা এবং স্বাদ এসব ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন এবং কৃতজ্ঞ। কিন্তু কল্পনার মাধ্যমে কত অমেয় পরিমাণ সম্ভাবনার দ্বার খুলে যেতে পারে তা কখনো অনুধাবন করি না। স্বপ্নের কাজ কী? স্বপ্নের আগমন কোত্থেকে হয়? আমরা স্বপ্ন দেখতে সক্ষম কেন? এবং কেন অবসম্ভাবীভাবে আমরা স্বপ্ন দেখব? স্বপ্ন যদি আমাদের জীবনে কোনো কাজেই না লাগে তবে স্বপ্ন দেখার কি কারণ থাকতে পারে? তবে শেষ পর্যন্ত একটা কারণ আমি পেয়েছি। আর তা হচ্ছে- আমরা কখন স্বপ্নকে অবলম্বন করি? যখন আমরা আমাদের পারিপার্শ্বিক নিয়ে অসুখী হয়ে পড়ি এবং কত বিস্ময়করভাবে সত্য হয় যে, পৃথিবীর কোনো স্বৈরাচারও এই স্বপ্ন দেখাকে প্রতিহত করতে পারে না। পৃথিবীর কোনো আইন দিয়ে মানুষের এই কাল্পনিক অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। মানুষ তার মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত স্বপ্ন দেখে যায়। শুধু ফ্যান্টাসি বা কল্পনা দিয়েই আপনি জীবনের অলঙ্ঘ দেয়াল পার করতে পারেন। সেই দেয়াল পার হবেন, আবার পেছন ফিরে চাইবেন। এই পেছন ফিরে চাওয়াটাই বাস্তবতা। অর্থাৎ আপনার স্বপ্নকে কতটুকু আপনি বাস্তবায়ন করতে পেরেছেন আর কতটুকু পারেননি। প্রকৃতপক্ষে, একমাত্র স্বপ্ন বা কল্পনাই আপনাকে আপনার কঠিন জীবন থেকে নিষ্কৃতি দিতে পারে, আপনাকে নতুন ঔজ্জ্বল্যে উদ্দীপিত করতে পারে, সেই উদ্দীপনা আপনাকে সেই স্বপের বাস্তবায়নের দিকে চালিত করে তা বাস্তবায়নযোগ্য করে তুলতে পারে। আর এভাবেই বাস্তব আর কল্পনায় আমাদের যাওয়া আর আসা চলে। কল্পনা হচ্ছে বাস্তব একটি বদ্ধঘরের জানালার মতো। মাঝে মাঝে সেই জানালা খুলবেন পরিপূর্ণ নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য। আর সিনেমা হচ্ছে আমাদের বদ্ধ বাস্তবতার সেই জানালাটি।

শনিবার, ১৪ মে, ২০১১

টকশোতে কথা বলার মতোজ্ঞান আমার নেই - সুবীর নন্দী

আমাদের দেশের শুদ্ধ সঙ্গীত চর্চায় সময়ের সাথে আধুনিক থেকেছেন সবসময় সুবীর নন্দী। টক শো’তে যাওয়া নিয়ে তার ভীষন এলার্জি। চাকরীতে রিটায়ার্ডের পর এখন সারদিন তার গান নিয়েই কাটে।  সাম্প্রতিক গানের ভাবনা ও কাজ নিয়েই বিনোদন প্রতিদিনের মুখোমুখি হয়েছেন বরেণ্য এই কণ্ঠশিল্পী।
সাক্ষাত্কার নিয়েছেন
 অপলা প্রিয়দর্শিনী
প্রথমে শুনতে চাই আপনাকে কোন টকশোতে দেখা যায়না কেন?
আমি এত কথা বলতে পারিনা। টকশোতে কথা বলার মতো জ্ঞান আমার নেই। যে অনবরত বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলবো। আমি গানের মানুষ এত কথা যদি বলি গান করবো কখন? তবে আমি সবার এই জ্ঞানগর্ভ কথা শুনতে ভালবাসি। প্রচুর টিভি শো দেখি। কয়েক মাস হলো আমি রিটায়ার্ড হয়েছি, এখন আমার অফুরন্ত অবসর। সারাদিন টিভি শো দেখি। আর এখন গানের চেয়ে বেশী তো টকশোতেই শিল্পীরা কথা বলেন দর্শক হিসেবে দেখতে ভালই লাগে।
রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকীতেও আপনাকে দেখা যায়নি, অনেক আধুনিক শিল্পীরাই রবীন্দ্রগান গেয়েছেন কিংবা কথা বলেছেন? তবে কি ইচ্ছে করেই আপনি দূরে ছিলেন?
না, তা হবে কেন? আসলে আমি অতি সম্প্রতি চীন সফরে গিয়েছিলাম। একেবারেই ব্যক্তিগত সফর। সেখানে আমার ছোট ভাই ইউএনডিপি বড় কর্মকর্তা। এই সময়টাতে আমি দেশের বাইরে থাকায় হয়তো গাওয়া হয়নি। তবে এক হিসেবে ভালই হয়েছে। আমরা বাঙালী সবকিছুতেই অতিরঞ্জিত না করলে মজা পাইনা। এবারেও এমনটাই দেখলাম। পুরো টিভি পর্দাকে যে যেভাবে পেরেছে রাবীন্দ্রিক করার চেষ্টা বা অপচেষ্টা করেছে। আমাকে খন্দকার নুরুল আলম ফোন করে বললেন,‘ কিরে তোকে তো দেখলাম না। বাকি সবাইতো গান করলো বা অনুষ্ঠানে হাজির হলো।’ তবে আমি প্রায় সবকটি অনুষ্ঠানই দেখার চেষ্টা করেছি। ভালই লেগেছে।
দুই বাংলার যৌথ আয়োজন হয়েছে, ওপার বাংলার অনেক শিল্পীও এসেছেন, কোন অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন?
স্বাগতালক্ষী শো দেখতে গিয়েছিলাম। যদিও আমার এই মেয়েটার কণ্ঠ বা গায়কী ভাল লাগেনি। কারণ কণ্ঠে কোমল বিষয়টা ওর ভেতর কম। যা রবীন্দ্রগানে বেশী জরুরী। আমি রবীন্দ্র গবেষক নই তবে অনুরাগী হিসেবেই আমার ইন্দ্রানী বা রেজওয়ানার গান যেভাবে টানে ওর গান সেভাবে টানেনি। দুই বাংলার আয়োজন বলতে এটুকু বলবো একটা ব্যপকতা ছিল। যা চোখে পড়ার মতো। এখন সেখানে ভাল কিছুও যেমন চোখে পড়েছে, অনেক অসঙ্গতিও চোখে পড়েছে। মন্দ গুলো নাইবা বলি। কারো মনে কষ্ট দিয়ে কী লাভ?
এবারে আপনার গানের খবর বলুন?
এক তরুন কম্পোজারের সুরে একটা সলো অ্যালবাম করছি। নামটা এখনই বলতে চাইনা। এটা আমি ইচ্ছে করেই করছি। নিজের গানে ভেরিয়েশন আনবার জন্য। আর ওর সুরও আমার ভাল লাগে দীর্ঘদিন ধরে। আশা করি আগামী মাস নাগাদ অ্যালবামটি শেষ করতে পারবো।
আমার জানা মতে আপনি নজরুলের গান গেয়েছেন বেশ কিছু, মঞ্চেও গেয়ে থাকেন। সামনে নজরুল জয়ন্তীতে কোন পরিকল্পনা আছে কি?
হ্যা আছে। নজরুলের গান গাইবো। এ নিয়ে আমি সুধীন দা’র সাথে বসারও পরিকল্পনা নিয়েছি। দাদার কাছ থেকে গানগুলি ঠিক করে তবেই গাইবো।
আপনি নিজেও অনেক সুর করেছেন, কম্পোজিশনের দিকে আগ্রহ আছে কি?
নাহ, একবারেই নেই। আমি এখন শুধু গান গেয়ে যেতে চাই। এখন চাকরী-বাকরি নেই। অখন্ড অবসর। তাই গানের রেয়াজ করি। আর প্রচুর গান শুনি। হিন্দী, ঊর্দু সবধরনের গান। খেয়াল শুনি। আর নিজেকে ভাঙতে থাকি। কবে আরো একটু ভাল করে গাইতে পারবো! আর তাই সুর বা কম্পোজিশনে মাথা ঘামাতে চাইনা। কিছু সুর করা আছে। কাজ করবো যদি ইচ্ছে হয়। তবে এখন গাইবার ইচ্ছেটাই বেশী। অনেক ভাল গান গাইবার ইচ্ছে। যে ক’দিন বেঁচে আছি আরো আরো ভাল গান গাইতে চাই। আর কম্পোজিশন সেখানোর জন্য অনেকেই বলে। কিন্তু কম্পোজিশন একটা নেশার মতো এটা করতে গেলে আমি ঐ গানের নোটেশন ভুল খুঁজতে থাকবো। গানটা আর হবে না।