রবিবার, ৮ এপ্রিল, ২০১২

লেখক যদি পাঠকেরকথা ভেবে লিখতে থাকে তবে সর্বনাশ - শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

‘আমার লেখার কোন ছক নেই। পরিকল্পনা নেই। লিখতে বসার আগে পর্যন্ত জানি না কী লিখবো। একটা মনে ধরার মত লাইনের জন্য অপেক্ষা করি। যদি ওই বাক্যটি পছন্দ হয় লিখতে শুরু করি। আমার লেখার ধরন অনেকটা তুলোর গুটি থেকে সুতো পাকানোর মত। ধীরে ধীরে একেকটি চরিত্রকে দেখতে পাই। তাদের মুখ, শরীর কাঠামো, পোশাক ভেসে ওঠে চোখের সামনে। তাদের জীবনযাত্রা, কথা দেখতে পাই। তখন আমার গল্প, উপন্যাস যেন হয়ে ওঠে একটি প্রতিবেদন লেখার মত। তবে এভাবে লেখা প্রত্যাশিত নয়। আমার ধরনটা বৈজ্ঞানিকও নয়। কিন্তু আমি নিরূপায়।’ বলছিলেন বাংলা সাহিত্যের অতুলনীয় লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। গতকাল রবিবার সকালে দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় তিনি এসব কথা বলেন।
শীর্ষেন্দু বলেন, ‘এমনও হয়েছে, বাক্যে একটি শব্দ খুঁজতে গিয়ে ১২-১৩ দিন লিখতে পারিনি। আবার কোন কোন দিন ১২-১৩ ঘণ্টা টানা লিখে গেছি। বাড়ির রান্না ঘরে যেমন অনেক তরকারি থাকে। কিন্তু সব নিয়ে তো রান্না হয় না। কিছু কিছু জিনিস নিয়ে একেক দিন রান্না হয়। প্রতিটি লেখকেরও তেমনি রান্না ঘর রয়েছে। কিন্তু তার অভিজ্ঞতা ও ভাবনায় যখনই যা আসে তা সে লেখে না। এসব জিনিসকে মজতে দিতে হয়। এরপর সে ঠাকুর ঘরে ঢুকে দেখবে যে সে কী লিখবে। ভাবনা চিন্তা ও অভিজ্ঞতাগুলোকে মজতে দিলে তা একদিন ত্রিমাত্রিক রূপ নিয়ে ফুটে উঠবে।’ তিনি বলেন, “পাঠকের কাছে আমার কোন প্রত্যাশা নেই। প্রত্যাশা রেখে লিখি না। তাহলে আপোষ করতে হতো। ১৯৬৭ তে ‘ঘূণপোকা’ যখন লিখি তখন তা পাঠক সেভাবে গ্রহণ করেনি। কেউ কেউ বলেছে, ওর লেখা পড়ো না মাথা খারাপ করে দেবে। কিন্তু আমি আমার বলবার ভাষা ও চিন্তাতে পরিবর্তন করিনি। আমার মতো করে লিখে গেছি। তবে দেরিতে হলেও পাঠক আমার লেখা গ্রহণ করেছে। পাঠকের সঙ্গে একটা সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে।’
শীর্ষেন্দু বলেন, “লেখক যদি পাঠকের কথা ভেবে লিখতে থাকে তবে তা সর্বনাশের ব্যাপার। খ্যাতি মানুষের বড় শত্রু। খ্যাতির জন্য, প্রতিষ্ঠার জন্য লেখা চলবে না। তা যদি কোন লেখক লেখে তবে লেখা তাকে ছেড়ে চলে যাবে। লেখক হতে গেলে তাকে অবশ্যই বৈরাগ্য অবলম্বন করতে হবে, সন্ন্যাসী হতে হবে। নিজের লেখার সমালোচক হতে হবে। এমনও হয়েছে আমি নিজের লেখা উপন্যাসের প্যার পর প্যারা, পাতার পর পাতা ফেলে দিয়েছি। নিজের লেখার ‘মার্সিলেস এডিট’ করতে হবে।”
শীর্ষেন্দু বলেন, ‘একটা সময় ছিল আমরা পশ্চিমবঙ্গের মানুষ বাংলা ভাষার ভবিষ্যত্ নিয়ে চিন্তিত ছিলাম। বাংলাদেশ রাষ্ট্র জন্মের পর সেই দুশ্চিন্তা কেটে গেছে। কারণ বাংলাদেশ ভাষাভিত্তিক দেশ। পৃথিবীতে বাংলার স্বীকৃতি এ দেশের জন্যই।’
বাংলা গদ্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলা গদ্যের চর্চা খুব কম হচ্ছে। বাংলা শব্দের ভাণ্ডার খুব কম। যদি নতুন নতুন বাক্য গঠন প্রণালীর চর্চা না করা হয়, তবে গদ্য খুব সাদামাটা হয়ে যাবে। অনেক লেখকেরই ভাবনা হয়তো খুব নতুন, উপযুক্ত। কিন্তু উপযুক্ত বাক্যে তা বলা না হলে ভাবনাটা মরে যায়। এর জন্য পরিশ্রম করতে হবে। অনুশীলন করতে হবে। পরিশ্রম না করলে তো কিছুই হবে না। এর পেছনে যন্ত্র ও প্রযুক্তি নির্ভরতাও রয়েছে। না চাইতেও এর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবন। এই যে, সেলফোনে মানুষ এত কথা বলে, এত কথা কিন্তু তার নেই। কিন্তু কথা বলতে বলতে বাসে চাপা পড়ে সে মারাও যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে এই সেল ফোন আমরা কথা বলতে না চাইলেও বলতে বাধ্য করছে। এইভাবে প্রযুক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি। প্রযুক্তির কারণে ভাষা বদলে গেছে। মানুষ বেশি কথা বলছে। ভাবনার ধরন বদলে গেছে। আর সৃজনশীলতা কমে গেছে। এই প্রভাব কাটানো সম্ভব কিনা জানি না।’
নিজের প্রসঙ্গে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘আমি সবসময় একটা চেতন অবচেতনে বিরাজ করি। অনেক সময় মনেও থাকে না আমি লেখক। অদ্ভূত ধরনের এক অন্যমনষ্কতা কাজ করে। রাস্তাঘাটে আমি খুবই অনিরাপদভাবে চলাচল করি। একজন ব্যক্তি অনেক টুকরোতে বিভক্ত হয়ে জীবনযাপন করে। স্ত্রীর স্বামী, সন্তানের বাবা, দোকানির খদ্দের। আমিও তাই। কিন্তু রাতে যখন একা হই তখন আমি ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠি। নিজেকে ফিরে পাই। তবে চেতনে অবচেতনে বিরাজ করলেও আমি জীবনকে উপভোগ করার চেষ্টা করি। আমার জীবনে ডাল ডে বলে কিছু নেই। প্রতিটি দিন উপভোগ করি।’
তিনি বলেন, ‘এক গভীর অবসন্নতা থেকে আমি ঠাকুর অনুকূল চন্দ্রের শিষ্যত্ব গ্রহণ করি। এরপর থেকে আমি যেমনতেমন জীবনযাপন করা ছেড়ে দিলাম। অনুশাসন মেনে চলা শুরু করি। তারই জন্য আমার জীবন ঊষর থেকে উর্বরা হয়েছে। জীবনে সংগ্রাম কম করতে হয়নি। নিদারুণ অভাব দেখেছি। ঘরে চাল থাকতো না। এসবই হয়েছে আমার জীবনাচরণের দোষে। নিজেকে বদলে ফেলার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবন থেকেও সমস্যা কাটতে থাকে। স্বচ্ছল না হই, অভাবক্লিষ্টতা কেটে গেল। ঠাকুরের বাণী নিয়ে গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়ানো আমার কাছে অমৃতস্বরূপ। গ্রামে যাদের কাছে যাই, তাদের কাছে আমি লেখক নই—গুরুভাই। তাদের সঙ্গে কোন দূরত্ব থাকে না। তখন আমার সঙ্গে সবার একটা সহজ সম্পর্ক হয়। এই ঘোরাফেরা ও মেলামেশার মধ্য দিয়ে আমি জীবনের এক শাশ্বত রূপ দেখতে পেয়েছি।
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘মাঝে মাঝে মনে হয়, কেন বেঁচে আছি। আমরা অসীমের মধ্যে বাস করি। কিন্তু জীবন নির্দিষ্ট। অনন্ত, অসীম বলে কিছুই কী নেই? সবকিছুই কী সময়ের গণ্ডিতে সীমাবদ্ধ?— এসব চিন্তা মানুষের অবচেতনে থাকে। সে এসবে প্রভাবিত হয়ে অবসন্নতা বোধ করতে থাকে। মানুষ বাস্তবতা ও কল্পনা উভয় জগতে বাস করে। দুটো স্বত্বাই সক্রিয় থাকে। আমার লেখায় মানুষের দুই অবস্থা তুলে এনেছি।
সাংবাদিকতা ও লেখক স্বত্বায় কখনো দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি? জবাবে শীর্ষেন্দু বলেন, ‘দেশ পত্রিকায় এখন সেভাবে সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত থাকতে হয় না। তবে যখন সাব এডিটর ছিলাম তখন স্পেশাল রিপোর্টিং-এর জন্য নানা জায়গায় যেতে হয়েছে। সেই কাজগুলো আমাকে বাস্তববাদী হতে সহযোগিতা করেছে। সাংবাদিকতার গদ্য ও এডিটিং স্টাইল আমার লেখায় উপকারে এসেছে। কারণ সাংবাদিকতার ভাষা অনেক বেশি কারণমুখী ও বাস্তবমুখী। প্রতিবছর বাজেটের কপি আমাকে দেখিয়ে নেয়া হতো। কারণ অফিস মনে করতো আমি বাজেটে মানুষের প্রত্যাশার হূদস্পন্দন ধরতে পারি। ফলে সাংবাদিকতা আমার মাঝে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করেনি।’
আত্মজীবনী লিখবেন?—জবাবে শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘উপন্যাসে নিজের জীবনের অনেক কথাই চলে আসে। নিজে থেকে কখনো লেখার তাগিদ অনুভব করিনি। তবে যখন ছেলে, স্ত্রীকে জীবনের নানা অভিজ্ঞতার কথা বলি তখন তারা তাগিদ দেয় সেই কথাগুলোকে লিখে রাখবার জন্য। বার বার বলেছে। কিন্তু আমি অলস মানুষ। দায়ে না পড়লে লিখি না।’
শীর্ষেন্দুকে ঘিরে আড্ডা : শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের সম্মানে ধানমণ্ডির বেঙ্গল শিল্পালয়ে কালি ও কলম পত্রিকা গতকাল এক আড্ডার আয়োজন করা হয়। এ সময় দেশের বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে নানা আলোচনায় মেতে ওঠেন তিনি। বিভিন্ন জনের প্রশ্নের জবাব দেন। আড্ডায় উপস্থিত ছিলেন প্রফেসর ইমেরিটাস আনিসুজ্জামান, অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, কালি ও কলম সম্পাদক আবুল হাসনাত, আসাদ চৌধুরী, শিল্পী সমরজিত্ রায় চৌধুরী, বিশ্বজিত্ ঘোষ, আন্দালিব রাশদী, মাকিদ হায়দার, আনিসুল হক প্রমুখ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন